• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৫৮ অপরাহ্ন

ক্রাচের কর্নেল – অমিত রায় সুপল

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৮১৬ ৪ ৯
আপডেট: সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০
ক্রাচের কর্নেল
ক্রাচের কর্নেল

অমিত রায় সুপল, অতিথি প্রতিবেদকঃ


তিনটি জীবন তাঁর। একটি ড্রেজিং কোম্পানির সরকারি চাকুরের, একটি প্রাক্তন সামরিক অফিসারের, আরেকটি গোপন বিপ্লবীর। যে মানুষটি এই তিনটি জীবন যাপন করছেন তিনি আবার পঙ্গু। এক পায়ের জীবন তাঁর। যেন ক্রাচে ভর দেয়া এক বিচিত্র বিস্ময়, সমান্তরালে টেনে নিচ্ছেন তিনটি জীবন – ‘পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন নিয়ে!’

একদিন মানুষটি তাঁর স্ত্রীকে বলেন, “বুঝলে লুৎফা, পেইন্টার ভ্যানগঘ প্রেমিকার জন্য তাঁর একটা কান কেটে ফেলেছিলেন, আমি তো দেশের জন্য একটা পা’ই কেটে ফেললাম।”

তিনি কর্নেল তাহের, একজন বিপ্লবী, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক হিরো, নিজেকে যিনি বলেছেন – ক্ষুদিরামের পথের যাত্রী, যাকে নিয়ে রচিত শাহাদুজ্জামানের বই ‘ক্রাচের কর্নেল’ এবং লেখকের ভাষায় – একজন অমীমাংসিত মানুষ।

কথা বলা যাক ‘ক্রাচের কর্নেল’কে নিয়ে। দেখা যায় ‘নক্ষত্রের ইশারা’য় শুরু হয় একটি গল্প। দু’পাতাও না এগিয়ে আমরা দেখে আসি ৪৭-এর ভারত বিভাজন। সেখান থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের নানা ঘটনাবলী। শুরু হওয়া গল্পটা সেখানেই থেমে থাকে। এর ফাঁকে আমরা দেখি এক মেজরের বেশে আপাদমস্তক বিপ্লবীকে। যিনি গড়েছেন এক ‘যূথভ্রষ্টের দল’। আমরা দেখি এক মহিলাকে যিনি ‘ধুলায় ঈষৎ ঢাকা’, তিনি আশরাফুন্নেসা, তাহেরের মা। জাদু দিয়ে গড়া এক নারী, যিনি সন্তানদের দীক্ষা দিয়েছেন অসম্ভবের মন্ত্রে। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে এই সন্তানরাই গড়ে তুলেছিল ‘ব্রাদার্স প্লাটুন’। এরপর তাহেরের আবির্ভাব ঘটে ‘না প্রেমিক, না বিপ্লবী’ রূপে। ঘটনা গড়ায়, আসে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ – ‘তোমরা প্রস্তুত হও’। তারপরই যে রাত আসে, ‘সে রাতে চাঁদ দেখেনি কেউ’। আর নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা দেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে নানা বেড়াজাল ডিঙিয়ে আসেন তাহের। ১১ নাম্বার সেক্টরে ‘গলফস্টিক হাতে সেনানায়ক’ যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। মাইন বিস্ফোরণে হারান বাম পা। আসে ‘বিষণ্ন বিজয়’। শুরু হয় ‘স্বপ্নের কারখানা’র কাজ। কিন্তু তার আগেই রোপিত হয়ে গেছে ‘বিষবৃক্ষ’। জ্বলতে থাকে ‘নানা জ্বালামুখ’। তবুও আশা, তবুও স্বপ্ন। গড়ে ওঠে ‘লাঙল ব্রিগেড’। কিন্তু থেমে যেতে বাধ্য হতে হয়। এরপর তিনি প্রাক্তন সামরিক অফিসার। ভাবেন ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’। সে লক্ষ্যে ‘নতুন পাঠ’। যদিও তখন ‘একে একে নিভিছে দেউটি’। বঙ্গবন্ধু শুরু করেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’। বাতাসে ভেসে বেড়ায় ‘অশনিসঙ্কেত’। কর্নেল তাহের সৃষ্টি করেন ‘নতুন ঘূর্ণি’। গড়ে তোলেন ‘সক্রিয় গণবাহিনী’।

এখানে একটু থেমে চোখ ফেরানো যাক অন্যদিকে।

ইতিহাসের নানা গলিঘুপচি ঘুরে লেখক উপস্থিত করেছেন অগণিত নায়ক-খলনায়কদের, দিনরাত্রি’র ফাঁকে ফাঁকে তুলে ধরেছেন সেসব চরিত্রদের কীর্তি-কুকীর্তির কথা। আর সেই অস্থির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে একলা ছুটে গেছেন একজন – ক্রাচ হাতে কর্নেল।

দেখা মেলে বঙ্গবন্ধুর, যিনি পূরণ করেছেন বাঙালিদের আজন্ম চাওয়া, স্বাধীনতার এজেন্ডা। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন যুদ্ধপরবর্তী দেশ পরিকল্পনামাফিক গড়তে। দশদিক থেকেই তাঁকে ঘিরে রেখেছিল স্বার্থান্বেষীরা। দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের চিনতে পারেননি। কাছের মানুষদের দূরে ঠেলে দিয়ে ঘর করেছেন ‘কালসাপ’দের নিয়ে।

উঠে এসেছে, বঙ্গবন্ধুর পেছনে ফাইল হাতে দাঁড়ানো ‘নটোরিয়াস’ লোকটার কথা; একজন অনন্য মানুষের কথা, যিনি একটি ডাকোটা বিমান নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে। বঙ্গবন্ধুর অভাব অনুভব হতে দেননি মুক্তিযুদ্ধকালীন। তিনি তাজউদ্দীন। অন্যদের কুপ্ররোচনায় বঙ্গবন্ধু অবজ্ঞা-অবহেলা করতে থাকেন তাজউদ্দীনকে। বুকচাপা কষ্ট আর অভিমান নিয়ে বিদায় নেন তিনি।

আখতারুজ্জামান আজাদের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক –

“তাজের দেশে তাজ থাকেনা, রাষ্ট্র ভরা মোশতাকে

বনের পশু পশুই থাকে, মানাও যত পোষ তাকে।..

..নিরুদ্দেশেই হাঁটছি কেবল, আমরা যারা হাঁটার দল

জায়গা করে নিচ্ছে ঠিকই আস্থা রাখা চাটার দল।”

এভাবেই চলে যেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। আর জীবনানন্দের ভাষায় তখন বঙ্গবন্ধুর অবস্থা – “সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা।” শেষে এই মহান মানুষটির ভাগ্যে ঘটে করুণ মৃত্যু।

দেখা মেলে আরেক উল্লেখযোগ্য চরিত্রের – জেনারেল জিয়াউর রহমান। যার বিশেষ কোনো স্রোতের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব নেই, যিনি, যখন ফলাফল অস্পষ্ট তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সব রকম পথ খোলা রাখেন। যেমন তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞা পালন করলেও চূড়ান্ত ক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালির দিকে। কারণ তিনি টের পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ ঐদিকেই। তেমনি দীর্ঘকাল নিরন্তর তাহেরের দিকে দরজা খুলে রাখলেও শেষ মূহুর্তে বন্ধ করে দিয়েছেন সে দরজা কারণ তাকে তখন ঘিরে রেখেছে আরও পরাক্রমশালী নানা শক্তি এবং তিনি টের পেয়েছেন ভবিষ্যৎ সেদিকেই। এই জিয়ার সঙ্গে তাহের তেলঢালার মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে বহুদিন চা খেতে খেতে গল্প করেছেন একসাথে, বাড়ির লনে বসে দেশের ভবিষ্যতের কথা বলেছেন, মাঝরাতে ফোন করে জেনারেল জিয়া তাঁর কাছে জীবনরক্ষার অনুরোধ জানিয়েছে, বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছে ধন্যবাদ; সেই জিয়াই প্রাণদাতা তাহেরের সঙ্গে করে বসে নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা। আদালতে দাঁড়িয়ে তাহের বলেছিলেন, “জিয়ার এই বিশ্বাসঘাতকতার তুলনা কেবল মীরজাফরের সাথেই করা চলে!”

এদিকে গল্প এগিয়ে চলে দ্রুত লয়ে। চোখের নিমেষেই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। একের পর এক ঘটে ক্যু, কাউন্টার ক্যু। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে তাহেরের। আজীবন লালিত সমাজতান্ত্রিক সোনার বাঙলা গড়ার স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে ঘটান উপমহাদেশের দ্বিতীয় সিপাহি বিপ্লব। চোখের পাতায় এঁকে রাখা রোমান্টিক সোনার বাঙলার ছবি, যা তাঁকে ঘুমুতে দেয়নি বহু রাত, সেই চিত্রকল্প যা গড়ার লক্ষ্যে তাহেরের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা ৭ নভেম্বর বিপ্লব ঘটায়। ঘটনার দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকলো। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ালো। আর পরাজিতের ছদ্মবেশে জয়ী হয়েও তাহের হলেন বন্দি। প্রহসনমূলক বিচারে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। নির্ভীক তাহের ফাঁসির মঞ্চে পাঠ করলেন মেজর জিয়াউদ্দীনের কবিতা – 

‘জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম।

জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম।

জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম।

জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম।

পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম।

পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।’

মহাপ্রস্থান হয় এক মহান বিপ্লবীর। যার হাঁটুর নিচ থেকে ঝুলে আছে নিরালম্ব শূন্যতা। ক্রমাগত ক্রাচের ঠক ঠক শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছেন নিজের নিয়তির দিকে।

তবে বইটি নিয়ে একটা হতাশার কথাও বলি। নক্ষত্রের ইশারায় লালমাটিয়ার শ্যাম্পুর বিরাট বিলবোর্ড থেকে সূচনা ঘটে যে গল্পের, যেখানে গোধূলীর আলো এসে পড়ছিল, যার নিচে লুৎফা দাঁড়িয়ে ছিল ছেলে মিশুর অপেক্ষায়, এককথায় যে নাটকীয়তা দিয়ে শুরু হয় ‘ক্রাচের কর্নেল’-এর পথচলা; কিছু সময় পরেই সেটা হারিয়ে যায়। মাঝেমাঝে অবশ্য ফিরে আসে শাহাদুজ্জামানের নিজস্ব শৈলীতে গল্প বলা, কিন্তু তা খুবই কম। তাঁর অন্যান্য বই পড়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং শুরুটা যেরকম সাবলীল ছিল পুরো বইয়ে সেরকম স্টাইল কম থাকায় একটু হতাশ হয়েছি।

যাইহোক, ‘পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন’ কথাটি সঞ্জীব চৌধুরীর। একদিন ইউটিউবে তাঁর টিএসসিতে করা একটি ঐতিহাসিক কনসার্টের ভিডিয়ো দেখি। ‘স্বপ্নবাজি’ গানটি গাইছিলেন।

“আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া,

স্বপ্নের ওই পাখি ধরতে চাই;

আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই,

আমার অন্তরের কথা বলতে চাই..।”

হঠাৎ গান থামিয়ে বলেন – “আপনারা যদি না বলেন কর্নেল তাহেরের খুনি কে, তাহলে আমি গান না গেয়ে এখান থেকে চলে যাব।” তখন দেশে বিএনপির ক্ষমতাকাল, তিনি কি ভয়ানক দুঃসাহসের সাথে সকলকে দিয়ে উচ্চারণ করালেন কর্নেল তাহেরের খুনি, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম।

শেষ করি তাঁরই আবেগভরা কণ্ঠে উচ্চারিত কবিতা দিয়ে –

‘মাটি ভিজে যায় রক্তে,

আর একজন কর্নেল তাহের

পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন নিয়ে-

আলিঙ্গন করেন ফাঁসির রজ্জু…’


Skip to toolbar