পুরোনো বই কেনা অনেকের নেশা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব বই পাওয়া যায় পুরোনো বইয়ের দোকানে। কিছু কিছু বই আছে আউট অফ প্রিন্ট। কিছু বইয়ের আছে নতুন সংস্করণ। নতুন সংস্করণ পাওয়া গেলেও পুরোনো প্রথম সংস্করণ কেনায় আলাদা একটা মাদকতা আছে। সেটা কেমন? দুএকটা উদাহরণ দিলে কিছুটা হয়তো বোঝা যাবে।
একবার একটা পুরোনো বই কিনলাম, নাম “সীমান্তের সিংহাসন”, সৈয়দ শামসুল হকের। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ। প্রকাশকাল ১৯৮৬। উৎসর্গ পাতায় সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, “দ্বিতীয় সৈয়দ হক। বাবা, এই বই যখন লেখা হচ্ছিল তখন তুমি হওনি। বই হয়ে বেরুতে বড্ড দেরী হয়ে গেল, তবু সে কথা একদিন তুমি হলে তোমাকে বলব বলে কল্পনা করেছি আর এ বই লিখছি। যে কথাটি বলবার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি- সাহসী হও, মানুষকে ভালোবাসো, মানুষকে বাদ দিয়ে দেশ নয়, মানুষকে ভালোবাসাই দেশকে ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসতেও সাহসের দরকার হয়। বাবা দ্বিতীয়, সাহস ও ভালোবাসা নিয়ে তোমরা সবাই বড় হও।”
সৈয়দ শামসুল হক আজ বেঁচে নেই।দ্বিতীয় সৈয়দ হক কত বড় হয়ে গেছেন।পুরোনো বইয়ের মলাট খুলে ভেতরে ঢোকা যেন একটা টাইম মেশিনে চড়ে বসা।
আরো পড়ুনঃ ক্রাচের কর্নেল – অমিত রায় সুপল
আরেকবার একটা বইয়ের ভেতরের প্রথম সাদা পৃষ্ঠায় দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কয়েকটা লাইন।
“তুমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।খোদা নিজ হাতে আমাকে এই উপহার তুলে দিয়েছেন। আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমায় জয় করবো। ভালো থেকো। আমার ভালোবাসা যেখানেই থাকো, সর্বদা আমারই থেকো।বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা রইলো।
১ লা বৈশাখ, ১৪১২
বীথি,মেডিক্যাল ক্যাম্পাস”
লেখাটা পড়ে ধুক করে উঠলো বুকের ভেতর। একজন প্রেমিকা তার ভালোবাসার মানুষকে বই উপহার দিয়েছে। লিখেছে তার হৃদয় নিঙরানো ভালোবাসার কথা। সে বইটাও বিক্রি হয়ে গেলো! কতো প্রশ্ন ভেসে বেড়াল মনে।তারা কি একজন আরেকজনের হয়েছে?নাকি হতে পারেনি? যদিও হয়ে থাকে একজন আরেকজনের, আগের সে ভালোবাসা কি বেঁচে আছে? নাকি আর্থিক অনটনে অথবা বাসায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় অথবা ভিন্ন কোন কারনে বইটা বেহাত হয়ে গেছে?
১১ অক্টোবর ২০১৯ এক ব্যক্তি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সামলাতে পারছেন না বলে ‘ব্যক্তিগত বাংলা লাইব্রেরি বিক্রি হবে’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেন একটি দৈনিক পত্রিকায়। প্রায় ৫০ বছর ধরে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বই এবং পত্রিকার সংগ্রগ বিক্রি করার ঘোষণা দেন তিনি।
বীথির প্রেমিকও হয়তো এরকম কোন কারণে বিক্রি করে দিয়েছিলো বইটা।আবার বিথী ও তার প্রেমিকের কথায় আসি। তারা যদি একজন আরেকজনকে না পায়, ভাবতেই শিউরে উঠলাম। বইটা হাতে নিয়ে মনে হলো আমি নিজেই সেই ভালোবাসার মানুষ। বইটা যেন বীথি আমাকেই দিয়েছে। তাকে আমি এখন খুঁজি কোথায়? পুরোনো বইয়ের মাদকতা এখানেই।
কোন কোন বইতে অবশ্য ঠিকানা, ফোন নাম্বারও লেখা থাকে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ এরকম ঠিকানা ধরে পৌঁছে যায় বইয়ের আসল মালিকের কাছে। এরকম ঘটনা বাস্তবে কি ঘটে? গল্পে অবশ্য ঘটতে দেখিছি। “দুজনার উপকথা” নামে মশিউল আলমের গল্প ছাপা হয়েছিলো প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় ২০১৫ সালে।
গল্পে নায়ক “রাশিয়ান উপকথা” নামের একটি পুরোনো বইয়ের ভেতর দেখতে পায় এই লেখাটা-
“নবম জন্মদিনে লাবনী মামনীকে বাবার শুভাশিষ।”
নিচে লেখা হয়েছে নাম,তাজুল আহমদ, নামের নিচে তারিখঃ ১৫ মে,১৯৮৪। তারপর ঠিকানাঃ৪৮ পূর্ব রাজাবাজার,ঢাকা।
বইটা এক বাবা উপহার দিয়েছেন তার নয় বছর বয়সী খুকিকে। হিসেব করে গল্পের নায়ক দেখলো, ২৩ বছর পেরিয়ে গেছে। ৯ বছরের খুকিটির বয়স এখন ৩২। এ কেমন মেয়ে? এতো সুন্দর একটা বই, উপরন্তু বাবার দেওয়া উপহার, কেন সে বইটা বিক্রি সযত্নে আগলে রাখেনি?নাছোড়বান্দা নায়ক নেমে পড়েন লাবনীকে খুঁজতে। একটাই উদ্দেশ্য লাবনীকে বইটা ফিরিয়ে দিয়ে বলতে, ‘বাবার দেওয়া উপহার যত্ন করে রাখতে হয়।’ খুঁজতে খুঁজতে লাবনীর সঙ্গে নায়কের দেখা হয়। তবে বইয়ে উল্লেখ করা ঠিকানায় নয়। দেখা হয় খুলনায়।বইটা পেয়ে অবাক বিষ্ময়ে লাবনী জানায়, “বইটা সে এক বান্ধবীকে দিয়েছিলো পড়তে। তারপর সে সের দরে বিক্রি করে দিয়েছে।”
গল্পের নায়ক লাবনীকে খুঁজে পেয়েছিলো। আমারও ইচ্ছে করছে বীথিকে খুঁজে বের করি। কিন্তু লাবনীর মতো বিথীর কোন ঠিকানা দেয়া নেই।
আবার এরকম অনেক বইয়ের দেখাও মেলে বিখ্যাত বা জনপ্রিয় কোন লেখককে নানান সম্ভোধন লিখে উপহার দিয়েছেন অখ্যাত কোন নবীন লেখক। বিখ্যাত, জনপ্রিয় লেখক হয়তো বইটা পড়েছেন, হয়তো পড়েননি। সংগ্রহে রাখার প্রয়োজন নেই মনে করে বিক্রি করে দিয়েছেন কেজি মেপে। এরকম বইগুলো যখন উল্টাই নবীন সে লেখকের কোমল করুণ মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যদি এরকম হয়, যে দিয়েছে বইটা সে-ই যদি বইটা আবার খুঁজে পায় পুরোনো বইয়ের দোকানে! অসম্ভব কিছু নয়।
এতোক্ষণ তো শুধু বললাম বইয়ের ভেতরের প্রথম পৃষ্ঠার কথা। পুরোনো বইয়ের ভেতরে পাতায় পাতায়, পাতার ভাঁজে ভাঁজেও লুকানো থাকে গোপন বিষ্ময়। উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ চোখে পড়ে যত্ন করে বানানো একটা বুকমার্কার, শুকিয়ে যাওয়া একটা গোলাপ ফুলের পাপড়ি, একটা প্রজাপতির পাখা, একটা ছবি, কিছু লিখে আবার কেটে দেয়া, শতো শতো আন্ডারলাইন আর মার্জিনে মন্তব্য।একবার একটা বই পেয়েছিলাম মাহমুদুল হকের “কালো বরফ”। ভেতরে অনেকগুলো লাইন হলুদ মার্কারে আন্ডারলাইন করা। লাইনগুলো পড়ে বুঝলাম, কোন এক প্রিয়জন তার প্রিয়জনকে এই লাইনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাচ্ছে তার ভালোবাসার কথা। কে বলে “বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়?”
একসময় বই উপহার দেয়ার প্রচলন ছিলো। বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে একজন আরেকজনকে বই উপহার দিতো। এটা এখন অনকটাই কমে গেছে। সেসব বইয়ের শুরুতে কতো বিচিত্র কথা লেখা থাকে। আরেকটা বইয়ের কথা বলে শেষ করি। বইটার নাম ‘আমার আছে জল’, লেখক হুমায়ুন আহমেদ। বইটা আগে পড়া থাকায় বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় শুধু কয়েকটা শব্দের একটা লাইন দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বোঝার বাকি রইলো না কে কাকে কেন উপহার দিচ্ছে। গেটা গোটা অক্ষরে চরম অভিমান নিয়ে কে যেন লিখে রেখেছে, ‘জানি পড়বে না।’
সাজিদ মোহন, সন্দ্বীপ জার্নাল ।