• শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন

বেলাল মোহাম্মদ : কিশোর জীবনী’র ভূমিকা

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৯০৩ ৪ ৯
আপডেট: শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বেলাল মোহাম্মদঃ কিশোর জীবনী'র ভূমিকা
বেলাল মোহাম্মদঃ কিশোর জীবনী'র ভূমিকা

বেলাল মোহাম্মদ (যাদুমণি) ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অগ্রদূত শব্দ সৈনিক। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের চাঁদ সওদাগরের ন্যায়। সমগ্র জীবনে নানা বঞ্ছনার শিকার হয়েও নতিস্বীকার করেন নি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের নর কীটদের নিকট। আজীবন সত্যের পথে পরিচালিত হয়েছেন নিরবধি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে; প্রথমেই যে বিষযটি সবার সামনে নক্ষত্রের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে ; তাহচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এখান থেকেই সর্ব প্রথম স্বাধীনতার মহান ডাক প্রচারিত হয়। আর এর মহান পুরোহিত ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
মোঘল বাদশা আলমগীরের নৌবহরের কমান্ডার ভাগ্নে দেলোয়ার খাঁ এর দোভাসী বকশি খাঁর প্রজন্মপরম্পরায় উত্তরসুরী বেলাল মোহাম্মদ ১৯৩৬ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্দ্বীপের ঐতিহ্যবাহি বনেদি পরিবার জন্মগ্রহণ করেন।
কবি বেলাল মোহাম্মদের কিশোরপাঠ্য জীবনী সম্পূর্ণ পর্বঃ
ছোট বেলায় মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণে তার মধ্যে কবিত্বের ভাব ফুটে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় লেখা-লেখির হাতে-খড়ি। কবিতা,গল্প,উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ মিলিয়ে পঞ্চাশের অধিক বই লিখেন; ঘটিয়েছেন বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের সমাবেশ; সৃষ্টি করেছেন স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস চর্চার মূল স্তম্ভ।
ছাত্রজীবনে অখণ্ড জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নে চট্টগ্রামের সদস্য হিসেবে যোগদান করে মানবতাবাদের প্রথম পাঠ নেন। পরবর্তী জীবনের নানা ঘটনা প্রবাহে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৫৪ সালের পর নয় বছর কাল কাটিয়েছেন মীরসরাইয়ে একজন সুফী সাধকের নিকট। ধর্মকর্মে আস্থাশীল না হয়েও নিজ ব্যক্তিত্ব গুণে মোহিত করেছেন সেই সাধু পুরুষকে। সাধুর শেষ রাতের জলসায় গান গাইতেন এবং প্রত্যহ তাঁর কাছ থেকেই এক টাকা করে হাত খরচ পেতেন। সাধুর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৫৭ সালে বিয়ে করেছেন প্রধান খাদেমের কন্যা কে। এতোটাই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ তিনি ছিলেন যে; সুফী সাধক তাঁর নিকট থেকে যাওয়ার প্রস্তাব করলে ; নিজের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার চিন্তায় অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ান।
১৯৬৪ সালে সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন দৈনিক আজাদীতে। তারপর সুফী সাধকের ইচ্ছা ও পরামর্শনুযায়ী রেডিও পাকিস্তানে।
মা-বাবার পঞ্চম সন্তান পঞ্চ পাণ্ডবের মতোই সাহসী ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা হৃদয়ে লালনকারী বেলাল মোহাম্মদ ২৬ মার্চে প্রথম প্রহরেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন কী করতে হবে। মৃত্যুর ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে এক কিলোওয়াটসম্পন্ন রেডিও ট্রান্সমিটার নিয়ে কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধকালীন সংযুক্ত থেকেছেন স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক হিসেবে এবং চাকুরি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান বাংলাদেশ বেতার থেকে।
১৯৭৩ সালে স্ত্রী বিয়োগের পর একমাত্র ছেলে আনন্দ কে নিয়ে বেঁচে ছিলেন। সারা জীবন সফেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরেছেন; পায়ে ছিল বিদ্যাসাগরীয় চটি; হয়ত বিদ্যাসাগরের মতো প্রায়োগিক দর্শনে বিশ্বাস ধারন করতেন। যাকে বিশ্ব জনীন হতে হবে ; শ্রীকান্তের ( শরতের শ্রীকান্ত উপন্যাসেন প্রধান চরিত্র) মতো ভবঘুরে জীবন যার ললাটের লিখন ; তাকে তো সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।প্রকৃতি তাই একমাত্র ছেলেকেও কেড়ে নিল ৩২ বছর বয়সে ১৯৯৮ সালে।
ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাংক ব্যালেন্স কিংবা ভূ-সম্পত্তি ছিল শূণ্য। ছোট বেলাকার দাদিজির কথা ফলেছিল অক্ষরে অক্ষরে ‘ যার হাতে থাকে শশী; সে খাবে বসি বসি’ কিংবা রবী ঠাকুরের ভাষায় ‘ এই বিশ্ব নিখিল লিখে দিল দু-বিঘার পরিবর্তে।’ মৃত্যুর পর দেহ উৎসর্গ করে গেলেন হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের জন্য।
জীবদ্দশায় খুব দেরিতে হলেও ২০১০ পেয়েছেন সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ২০১২ সালে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার। সোনার মেডেলখানা দিয়ে দিলেন বাংলাদেশ বেতার কে ।
এছাড়াও আরো নানা পুরস্কার আর সম্মাননা পেয়েছেন।ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্ত। মোজাফফর আহমেদ, লাল মোহন সেনের আদর্শে আজন্ম অনুপ্রাণিত নির্লোভ ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষ ২০১৩ সালেের ৩০ শে জুলাই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
শিশুসাহিত্যিক সাজিদ মোহন শিশু ও কিশোরদের উপযোগী করে চমৎকার ভাষাশৈলির মাধ্যমে বেলাল মোহাম্মদের জীবনী রচনা করেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের সমাহর ঘটিয়েছেন। বেলাল মোহাম্মদের সমগ্র জীবনের সার নির্যাস রয়েছে এই বইতে। সহজ-সরল ভাষায় প্রতিথযশা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের অধীকারী একজন মানুষের সমগ্র জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা খুবই কষ্ঠসাধ্য কাজ; আর এ কাজটি অত্যান্ত ধৈর্য ও ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন কবি সাজিদ মোহন। বেলাল মোহাম্মদের কিশোর পাঠ্য জীবনী বলা হলেও রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন

উপজেলা শিক্ষা অফিসার  । সন্দ্বীপ,চট্টগ্রাম।

সন্দ্বীপজার্নাল/ইএএম/এসএম


Skip to toolbar