• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:২৯ অপরাহ্ন

শেকড়ের শোকে

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৬৩৪ ৪ ৯
আপডেট: মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০
শেকড়ের শোকে
শেকড়ের শোকে

শেকড়ের শোকে

মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই, জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই, ভাঙনের যে নেই পারাপার, তুমি আমি সব একাকার – নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভূপেন হাজারিকার এ গান শুনতে শুনতে মনে পড়ল; এখানে ছিল সীমাদের বাড়ি। তারপাশেই শাহাদাতভাইদের বাড়ির আর কোনো চিহ্ন নেই। জলে এসে একাকার হয়ে গেছে সব। আমাদের বাড়ির দিকে চেয়ে বুঝলাম, নদী খুব করে চাইছে তার পরিধি বাড়াতে। তাই আর কিছু দিন পরই বিলীন হতে যাচ্ছে সেটাও।

শৈশব কৈশোরের এতো এতো স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলো নদীতে পরিণত হতে এখন কেবল কিছু সময়ের অপেক্ষা। অপেক্ষা নতুন বাড়ি করবার। অন্য কোথাও গিয়ে খুঁটি গারবার।

অন্যত্র গৃহের স্থানান্তরের ঘটনা আমার জন্য প্রথমবার হলেও নতুন নয় বাবার কাছে। এ দৃশ্য তারা দেখেছেন আরো দু’বার। ভিটেমাটি নদীতে হারিয়ে সন্দ্বীপ থেকে উড়িরচর আসার পর; এখানেও ভাঙন রেহায় দেয়নি তাদের।

যতোটুকু শুনে জেনেছি; দাদা বাড়ি ছিল সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নে। সেখানে তারা পুরো গোষ্ঠীসমেত একসাথে থাকতেন। ব্যবসা করে ভালোই চলছিল তাদের দিন। কিন্তু বিপত্তি হয়ে দাঁড়ালো সর্বনাশা নদী। একে একে গ্রাস করলো সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড়, কাটগড়, বাটাজোড়া সহ অনেকগুলো ইউনিয়ন। [যদিও এখন দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নে ফের চর জেগেছে। বসতি আছে। নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ আছে ।

দীর্ঘাপাড় ভেঙে যাওয়ার পর ৮২ সনে দাদার ৪ ভাই আর তাঁদের ১১জন চাচাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন সমুদ্রের বুকে সদ্য জেগে উঠা উড়িরচরে। ইতোমধ্যে চরটিতে প্রায় ২ শ লোকের বসবাস। যাঁরাও এদের মতো সর্বস্ব রেখে এসেছে নদীতে।

উড়িরচর এসে নিজের মতো করে প্রত্যেকে বসবাস শুরু করে। ক্রমে মানুষ বাড়তে থাকে। হাড়ভাঙা খাঁটুনির মাধ্যমে বনজঙ্গলকে বসবাসের উপযোগী করে তোলে। ধীরেধীরে দু’একটা দোকানপাট হতে থাকে।

আরো পড়ুনঃ উড়িরচরের ভোটার না, তাই ত্রাণ পাইনি

ঠিক তখনই হানা দেয় ৮৫’র বন্যা। দাদার ৯ সন্তানের মধ্যে ভেসে যায় ৪ জন। দুই ফুফু আর ২ চাচাকে আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার দাদীর মতো পঁচাশির বন্যায় সন্তান হারিয়েছেন উড়িরচরের আরো অনেক মা। এজন্যই চরের মানুষের কাছে বন্যা এক শোকের মাতম, বন্যা জলোচ্ছ্বাসের নাম উঠলে স্বজন হারানোর ব্যাথায় কাতুর হন এরা।

উনিশ শ পঁচাশির বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। চাষ করে খাওয়ার জন্য দিয়েছিলেন এক জোড়া করে গরু আর নাঙল। সাহায্য নিয়ে ছুটে এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভারতের রাজিব গান্ধী। ভারতের সহায়তায় হয়েছিল বিশাল দীঘি, পাকিস্তান মসজিদ নামে একটি মসজিদও করা হয়েছিল সে দেশের আর্থিক সহায়তায়।

তারপর ঘুরে গেছে ১৯৯১’র বন্যা। সন্দ্বীপে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে মোাটামুটি নিরাপদ ছিল উড়িরচর।

কিন্তু একানব্বইর পর আগ্রাসী রুপ নেয় উড়িরচরের দখিন পাশের নদী। নদী ভাঙা মানুষকে কোনো ছাড় দিতে রাজী নয় সে। যেন এদের উপর দেখাতে হবে তার সর্বশক্তি।

ফলে উড়িরচর এসে দাদারা যে বাড়ি করেন, তা ভেঙে যায়। ভেঙে যায় আমাদের যৌথ পরিবার। বাবারা তিনভাই তিন জায়গায় আলাদা তিনটি বাড়ি করেন।

আরো পড়ুনঃ খাদ্য বিভাগের পৌষ মাস: কৃষকের সর্বনাশ

সেই তিনটি বাড়ির মধ্যে এটি একটি। এখানেই আমাদের বেড়ে উঠা। এই বাড়ির আনাচে-কানাচে ছিল আমাদের বিচরণ। ৪ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বাড়িতে আমাদের ভাইবোনদের কেটেছে শৈশব আর কৈশোর।

আগের বাড়ির কথা কিছুই মনে নাই আমার। তবে এ বাড়িতে কীভাবে এলাম – এখনো চোখে ভাসছে। বাড়ির পূর্বদিকে তখন বাগান ছিল। প্রতিদিন বাগান থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসতো। সন্ধ্যা হলে প্রায় দেখা মিলতো শেয়ালের।

আমাদের বাড়ির দরজায় পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের পাশেই ইউনিয়ন পরিষদ ভবন হওয়ায় এ জায়গাটার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল পুরো চরে।

বাড়ির সামনে ইউপি ভবন থেকে পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে জি.ইউ সৈকত প্রাইমারি স্কুলের দিকে যে রাস্তাটা গেছে, সেটাই উড়িরচরের প্রথম পাকা রাস্তা। বর্ষার সময় স্কুলের বন্ধুরা যেখানে লুঙ্গি/হাফপ্যান্ট পরে কাঁদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতো, তখন আমরা প্রায় জুতা পরে যেতে পারতাম। এতে আমাদের দম্ভের কমতি ছিল না। অন্যদিকের বন্ধুদের এসব বলে ক্ষেপাতাম খু্ব।

ফরেস্টের বিলুপ্তির সাথে এদিকে বাড়ছিল মানুষের বসতি। দু’মাথা, চার মাথা করে অনেক মানুষের সমাগত হতে থাকে এ পাড়ায়। সমবয়সীদের মধ্যে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। স্কুলে যাদের সাথে পড়তাম, বিকেলে তাদের সাথে খেলতাম। বড়ো ছোটদের নিয়ে যে কমিউনিটি এখানে গঠিত হয়েছিল, তাতে ছিল আন্তরিকতা আর সম্প্রীতি।

পঞ্চম শ্রেণি শেষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ব বলে সন্দ্বীপ চলে যেতে হয় আমাকে। তারপর আর একনাগাড়ে বেশিদিন থাকা হয়নি এ পাড়ায়। সম্ভবত এবার এই লকডাউনের কারণেই সবচে বেশিদিন ধরে আছি।

তবে আগে যেমন একটা আমেজ ছিল, সারাদিন কোলাহল আড্ডা আর হাসিঠাট্টার আওয়াজ ভাসতো, এখন আর তেমনটি নেই। কারণ নদী ভেঙে অনেকে ছেড়ে গেছে এ পাড়া।

পোষা বালিশের নিচে পথঘাট, যাঁরা সস্তায় ঘুম কিনতো, তারা কবে ছেড়ে গেছে বন্দর, আমি পালটে নিয়েছি রিংটোন। মানুষগুলো এখান থেকে চলে যাওয়ায় এরকমই মনে হচ্ছে। এই যে এখান থেকে গিয়ে আরেক জায়গায় বাড়ি করছে, থাকছে, জীবন পার করছে – এক জীবনে এতো স্মৃতি আর নস্টালজিয়া নিয়ে কি পেরে উঠা যায়?

ভাঙা গড়ার এ পৃথিবীর স্রষ্টাকে নজরুল এজন্যই বলেছিলেন, ‘ খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে ‘


নুর নবী রবিন

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম


Skip to toolbar