২৫ মার্চ কালোরাত্রি ১৯৭১। নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি সামরিক দস্যুরা। নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে রাতেই তারা দখল করে নিলো মহানগরী ঢাকা। পরদিন সকালবেলা ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হতে লাগলো সামরিক নীতিমালা।বিমান চলাচল বন্ধ। রেলপথ, জলপথ ও অন্যান্য সড়ক যানবাহনের অচলাবস্থা।রাজধানীর সাথে অন্যান্য শহরের টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। ডাক ও টেলিগ্রাম বিকল। সংবাদপত্র বিতরন ও মুদ্রণ স্তব্দ। শুধু খোলা দখলদারদের অপপ্রচারের একচেটিয়া মাধ্যম ঢাকা বেতার কেন্দ্র।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বেতার ও টেলিভিশনের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, বাঙালির আন্দোলনের খবর যদি প্রচার করা না হয়, তবে কোন বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবে না। ২৬ মার্চ প্রভাতী অধিবেশনে বন্ধ করে দেয়া হলো চট্টগ্রাম বেতারেও। কর্মীরা সবাই আগ্রাবাদের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যান।
সকাল এগারোটায় ডা. মোহাম্মদ শফীর বাসা থেকে বের হলেন যাদুমনি। পথের সাথী দুজন, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক। উদ্দেশ্য একটাই, রেডিওকে যদি কাজে লাগানো যায়। প্রথম গন্তব্য স্টেশন রোডের জহূর আহমদ চৌধুরীর দপ্তর। নেতাদের আনুকুল্য পেলেই বেতার চালু করা সম্ভব। কিন্তু পরিচিত নেতাদের কাউকে সেখানে পাওয়া গেলো না। তারপর যাদুমনি গেলেন রেলওয়ে বিল্ডিং-এ ইপিআর কমান্ডার রফিকুল ইসলামের কাছে।প্রস্তাব দিলেন, বেতার কেন্দ্রের পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য। কথা দিলেন কমান্ডার। এক ঘন্টার মধ্যে বিশজন জোয়ানকে আগ্রাবাদ এবং পনেরোজনকে কালুরঘাট পাঠাবেন। পথে পথে ব্যরিকেড। দুদিন আগে বন্দরে নোঙর করেছে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ বাবর ও সোয়াত। জাহাজ দুটি ভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র।এসব যেন সেনানিবাসে ওরা বয়ে নিতে না পারে, বড়ো বড়ো কাঠ পাথর ফেলে রাখা হয়েছে এখানে ওখানে। রাস্তার ওপর পিচের ড্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
সারাদিন ঘুরে বিকেলে যাদুমনি গেলেন আগ্রাবাদ বেতার ভবনে। ওখানেই কথা হলো সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ আবদুল কাহহারের সঙ্গে। তিনি বললেন, বেলাল সাহেব, আপনারা বেতার চালু করতে চান করুন। তবে আগ্রাবাদ থাকবেন না। আগ্রাবাদ বন্দর থেকে খুব কাছে। এলাকাটায় যে কোন সময় পতন ঘটতে পারে। আপনারাও মরবেন, যন্ত্রপাতিও নষ্ট হবে। আপনারা বরং কালুরঘাট চলে যান। ওখানে একটা ক্ষুদে স্টুডিও আছে। ওখান থেকেই সব প্রচার করতে পারবেন।
সন্ধ্যায় কালুরঘাট এসে যাদুমনি দেখলেন, কমান্ডার পাহারার ব্যবস্থা করেননি।
এরই মধ্যে দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান কয়েকজন বেতার প্রকৌশলীকে দিয়ে কালুরঘাট প্রচারযন্ত্র চালু করে দিয়েছেন। নিজের নাম পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার ওপর পাঁচ মিনিট বক্তব্য প্রচার করেছেন। কাগজপত্র গুছিয়ে স্টুডিওতে ঢোকার জন্য দাঁড়ালেন যাদুমনি, অমনি বার্তা সম্পাদক সুলতান আলীর চাপা কন্ঠ, বেলাল সাহেব, আপনারা দেরী করছেন কেন? যা পারেন প্রচার শুরু করে দিন।এখন সাড়ে সাতটা। লোকেরা রেডিওর কাটা ঘোরাচ্ছে। পৌনে আটটা বাজলেই কলকাতার ‘আকাশ বানী’ ধরবে।আপনাদেরটা কেউ শুনবে না।
যেই কথা সেই কাজ। ঠিক সন্ধ্যা সাতটা চল্লিশ মিনিটে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কন্ঠে প্রচারিত হলো,’স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ বিভিন্ন কন্ঠে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর দেয়া আনুষ্ঠানিক জরুরী ঘোষনাটিও প্রচার করা হলো বারবার। ‘অদ্য রাত ১২ টায় বর্বর পাক-বাহিনী ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিতে হামলা চালায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধ চলছে।আমি এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং সমস্ত বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশসমূহের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করছি। জয় বাংলা।’
কালুরঘাট ট্রান্সমিটার মধ্যমতরঙ্গ দশ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন। সাধারনভাবে এই কেন্দ্রের শোতৃএলাকা পঞ্চাশ মাইল রেডিয়াসের মধ্যে। কিন্তু ঐ সময় রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও সিলেট কেন্দ্র স্তব্দ থাকায় মধ্যবর্তী ইন্টারাপশন ছিল না। ফলে দশ কিলোওয়াট মধ্যমতরঙ্গ ট্রান্সমিটার থেকে উৎক্ষিপ্ত শব্দ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছালো ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে। ২৬ মার্চ সূচনা অধিবেশনের স্থিতিকাল আধঘন্টা।সমাপ্তিতে বলা হলো, পরদিন সকাল ৭টায় আবার অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে।
২৬ মার্চ রাত। অনেক কাজ যাদুমনির হাতে, মাথায় অনেক ভাবনা। কালুরঘাট প্রচার ভবনটি অরক্ষিত।পাহারার জন্য দরকার রাইফেলধারী জোয়ান।
ঠিক ঐ সময় অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত বন্ধু তাহের সোবাহানের টেলিফোন, বাবার ও সোয়াত নামের দুটি জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাবার কাজে একজন বাঙালী মেজর দেড়শ জোয়ানসহ পতেঙ্গায় ছিলেন। তারা আর সেনানিবাসে ফিরে যাননি। পটিয়াতেই আছেন। কিন্তু বন্ধুটি মেজর সাহেবের নাম বলতে পারলেন না।
রাতে একফোঁটা ঘুমও এলো না যাদুমনির। ভোরেই পটিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কারণ, হাতে সময় একেবারেই কম। আরেক বন্ধু মাহমুদ হোসেনের ভাড়া করা ট্যাক্সিতে পটিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন যাদুমনি। সঙ্গে ফারুখ চৌধুরী, ওসমান গনি ও দুজন সৈনিক। মাহমুদেরও গোপন একটা মিশন আছে, সীমান্ত পার হয়ে ভারত যাওয়া। মোরারাজ দেশাই তার আত্মীয়। সেই সুবাদে অস্ত্র সাহায্য নেবেন। গোলাবারুদ ছাড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠেকাবার উপায় কী! এজন্য মেজর সাহেবের সাহায্য প্রয়োজন।
১৬/১৭ মাইল পথ পেরিয়ে পটিয়া পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। পটিয়া থানায় মানুষের ভীড়। অনুমতি নিয়ে যাদুমনি ও মাহমুদ যখন ভেতরে ঢুকলেন, মেজর তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন। পরিচয় পেয়ে মেজর দারুণ উচ্ছাসিত। দেরী না করে যাদুমনি বললেন তার কথাটা, কালুরঘাট বেতার ভবনটিতে যদি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে পারেন। তারপর বললেন মাহমুদ, বর্ডার ক্রস করতে হবে। আপনি শুধু একটা স্লিপ লিখে দেবেন, আমরা আপনার লোক। ওতেই হবে।
দুপুর গড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। খেয়েদেয়ে তিনটি লরিতে জোয়ানদের একটু আগে পরে যাত্রা। একটি লরি অদৃশ্য হবার পর অন্যটির স্টার্ট। সঙ্গে আছেন মেজরও।গাড়ি চলছে পটিয়া টু কালুরঘাট। সারা পথে মাথায়, হাতে মালামালসহ লোকজন। শহরতলির কর্মস্থল ছেড়ে যাচ্ছেন সবাই। পথে গাড়ি থামিয়ে খন্ড জনতার উদ্দেশ্যে মেজর বললেন, আপনারা কেউ শহর ছেড়ে যাবেন না।কার ভয়ে পালিয়ে যাবেন? দুশমনদের আমরা দুদিনের মধ্যেই ধ্বংস করে দেবো। এই একই বক্তব্য তিনি রাখলেন পথে অন্তত দশ জায়গায় গাড়ি থামিয়ে।
কালুরঘাট প্রচার ভবনে পৌঁছতে পৌঁছতে পাঁচটা বেজে গেলো। এর আগেই জোয়ানেরা এলাকাটির চারিধারে পরিখা খনন করে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। অফিস কক্ষে শুধু দুজন। যাদুমনি আর মেজর জিয়াউর রহমান। নিতান্ত রসিকতা করে যাদুমনি বললেন, ‘আচ্ছা মেজর সাহেব, এখানে আমরা সবাই তো ‘মাইনর’, একমাত্র ‘মেজর’ হিসেবে আপনার কন্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়।’ মেজর গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন প্রস্তাবটি।বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কি বলা যায়, বলুন তো?’
দুজনের আলোচনায় প্রতিটি শব্দ উচ্চারন করে করে প্রথম বাক্যটি লেখা হলো, ‘I, Major Zia, On behalf of our great leader Bangbandhu Sheikh Mujibur Rahman do hearby declare independence of Bangladesh.’ মেজর এবার উচ্চকন্ঠে ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডাকলেন। তিনজনের আলোচনায় খসড়াটি চূড়ান্ত হল। ‘Khuda Hafez, Joi Bangla.’ দিয়ে ঘোষনার সমাপ্তি। ২৭ মার্চ সন্ধ্যা অধিবেশনে মেজরের সকন্ঠে ইংরেজি ঘোষনাটি প্রচার করা হলো। মুহূর্তেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আলোড়ন, উত্তেজনা।
ওদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাঙালির প্রাণ ভোমরা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। খুঁজতে খুঁজতে এরইমধ্যে পেরিয়ে গেছে ২৮ ও ২৯ মার্চ। ৩০ মার্চ দুপুরের অধিবেশন শেষ হবার পর কেউ কেউ প্রচার ভবনে, কেউ কেউ বসে আছেন পাশের রিসিভিং সেন্টারে। সান্ধ্য অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছে, এমন সময় দূর থেকে ভেসে এলো বিমানের শব্দ। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ছুটে বাইরে গেলেন। আবার ভেতরে এসে বললেন, বেলাল ভাই, আমার মন বলছে এখনই এখানে বোমা পড়বে। এ দুটি বোমারু বিমানের টার্গেট আমরাই।
বিমানের শব্দ আরও কাছে এসে যাচ্ছে।কাঁপতে কাঁপতে একজন জোয়ান এসে ছিটকে পড়লো যাদুমনির কাছেই। হাত থেকে খসে পড়লো রাইফেলটা। উপুর হয়ে শুয়ো পড়লেন যাদুমনি। বেলা তখন ২.১০ মিনিট। শুরু হলো বোমা বর্ষন, পাকিস্তানি সামরিক দস্যুদের প্রথম বোমা হামলা।লক্ষ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
মাথার উপর একের পর এক বোমা বর্ষনের শব্দ। নিজের মধ্যে তবুও আশ্চার্য এক সাহস অনুভব করলেন যাদুমনি।আহত জোয়ানটি মৃগী রোগীর মত তড়পাচ্ছে। রেজাইল করিম চৌধুরীর এক কানের রুমালের ছিপিটা খসে পড়ল। সেটা আবার লাগানোর জন্য কানের ফুটো খু্ঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
এরই মধ্যে আবুল কাসেম সন্দ্বীপ আরেক বন্ধু আবদুল্লাহ আল ফারুককে ডেকে বললেন, ভাই, আমার পকেটে দেড়শ টাকা আছে। আমি যদি মরে যাই, টাকাটা আপনারা নিয়ে নেবেন।
ছাদটাই বুঝি ভেঙে পড়বে। সে অবস্থাতেই আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কথায় যাদুমনির খুব হাসি পেয়ে গেলো।আরেক বন্ধু কাজি হাবিব উদ্দিন আহমেদ ধমকে উঠলেন, হাসবেন না, হাসবেন না।আপনার জন্যই তো এতো কিছু! যাদিমনি নির্ভিক। উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, একটা বিমানে কটা বোমা থাকে?
মোট দশটা শব্দ শুনেছেন যাদুমনি।হামলার স্তিতিকাল আনুমানিক দশমিনিট।তারপর বোমাবাজি শেষে বিমানের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যেতেই সবাই বেরিয়ে এলেন। গেটের বাইরে রাস্তায় শুধু একটা কুকুর মারা গেছে! অফিস-কক্ষের ভেতরে নিক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে বুলেটখন্ড। পতাকা ওড়াবার খুঁটিটি ধ্বসে পড়েছে। পেছনের তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে তারপর ধানক্ষেতের আলপথ বেয়ে নিরুদ্দেশ ছুটতে শুরু করলেন যাদুমনি। সঙ্গে আবদুল্লাহ আল ফারুক ও কাজি হাসিব উদ্দিন।
হঠাৎ কানে এলো, ‘ঐ রে বিহারি পালাচ্ছে।ধর ধর।’ ভয়ে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন সবাই। কাছে ছুটে এলো তিন-চারজন যুবক। মারমুখো যুবকদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেলো যাদুমনির কল্যানে। চট্টগ্রাম বেতার থেকে পুঁথির আকারে দৈনন্দিন যুদ্ধের (পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫) খবর প্রচারের জন্য শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি ছিলো যাদুমনির। নাম-পরিচয় দিয়ে মোহরা গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন সবাই।
ওদিকে চকোরিয়ার হারবাংয়ে আটক হলেন মাহমুদ, ভারত যাওয়ার পথে। মেজর জিয়ার দেয়া পরিচয়পত্র উপেক্ষিত হল। সিআই এর দালাল ঘোষণা করা হল তাকে। শঙ্খ নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হলো ফারুক চৌধুরী, ওসমান গনি ও মাহমুদ হোসনকে।
৩১ মার্চ সবাই সম্মিলিত হলেন প্রচার ভবনে। কালুরঘাট এলাকার পতন আসন্ন।অনুষ্ঠান প্রচারের বিকল্প ব্যবস্থা ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার ট্রাকে বোঝাই করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। দ্রুত হাতে তার কেটে ট্রান্সমিটার ডিসমেন্টাল করলেন হারুনর রশিদ খান, টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট আমিনুর রহমান ও মেকানিক আব্দুশ শুকুর। ওঠানো হলো ট্রাকে।ট্রান্সমিটারসহ ট্রাক পৌঁছাল পটিয়ায়।রাখা হলো পটিয়া মাদ্রাসায়। প্রকৌশলী মোসলেম খান বললেন, ট্রান্সমিটারটি পটিয়ায় ইনস্টল না করতে। বললেন, ভারতের কোন সীমান্ত এলাকায় চলে যেতে। সীমান্ত এলাকা নিরাপদ।পাকিস্তানিরা ওখানে বিমান হামলা করতে পারবে না।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাগাফা-শালবাগান-আগরতলা
৩ এপ্রিল শুরু হলো যাদুমনিদের নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা। সন্ধ্যায় পৌঁছলেন রামগর। রামগর থেকে সাবরুম। পাহাড়ি রাস্তা ধরে সাবরুম থেকো ত্রিপুরার বাগাফা। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৯২ হেড কোয়াটার্সে। রাত দশটায় শুরু হলো শর্টওয়েভ ৬১.৬৩ মিটারব্যান্ডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিবেশন। বাজানো হলো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের সুর, আমার সোনার বাংলা এবং আরও কয়েকটি গান।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৯২ হেড কোয়াটার্স শালবাগানে রয়েছে ৪০০ ওয়াট শক্তির ট্রান্সমিটার। শালবাগান আগরতলা শহরের সন্নিকটে। সংবাদ-তথ্য সংগ্রহের সুবিধা আছে। আগরতলা শহরে আছে বাংলাদেশের নেতাদের অফিস।যাদুমনিদের শালবাগানে স্থানান্তরের আকষ্মিক সিদ্ধান্ত নিলেন কর্তৃপক্ষ।
৮ এপ্রিল লরিয়ে উঠে বসলো সবাই।শালবাগান পৌঁছে সিদ্ধান্ত হলো সীমান্তরক্ষী ক্যাম্পে নয়, যাদুমনিদের থাকার জায়গা হবে আগরতলা শহরে।ট্রান্সমিটারের কাছে কেউ যাবে না। সব আগে রেকর্ড করা হবে গোপনে। শহরে সবার নাম পরিচয় গোপন থাকবে। সবাই নিজের নাম পাল্টে ফেললেন। যাদুমনি নিজের নাম পাল্টে রাখলেন লালমোহন।সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামের লালমোহন সেন ছিলেন সূর্যসেনের দলের সবচেয়ে কমবয়স্ক সদস্য। ১২ এপ্রিল প্রভাতী অধিবেশন দিয়ে শুরু হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
২৮ এপ্রিল এক বৈঠকে কেন্দ্রিয় সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী সৎপথীকে যাদুমনি বললেন, আমরা সর্বশক্তি দিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করছি। কিন্তু টার্গেট এরিয়া কভার হচ্ছে না।বাংলাদেশের সর্বত্র আমাদের কন্ঠ পৌঁছুচ্ছে না। ট্রান্সমিটার খুব কম পাওয়ারের। শর্টওয়েভ। আপনার কাছে একটা পাওয়ারফুল ট্রান্সমিটার চাই। সৎপথী বললেন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা মিডিয়ামওয়েভ উচ্চশক্তির ট্রান্সমিটার তোমাদের প্রচারের জন্য দেয়া হবে। কয়েকদিন পর খবর এলো ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা হয়েছে। ফিফটি কিলোওয়াট মিডিয়ামওয়েভ। দেয়া হবে মুজিবনগর-কলকাতায়। ২৬ মে যাদুমনি যাত্রা শুরু করলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতা(মুজিবনগর)
২৬ মে দুপুরে কলকাতায় পৌঁছে প্রথমেই একটা খাতায় নাম লিখলেন যাদুমনি।বালিগন্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৫৮ নং দ্বিতল বাড়ি। নিচের তলায় একটি কক্ষে থাকেন এম মনসুর আলি ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। দোতালার সিঁড়ি বেয়ে উঠলে প্রথম কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মাঝের কক্ষটিতে তাজুদ্দিন আহমদ। শেষ প্রান্তের কক্ষটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামান থাকেন অন্য কোথাও।
শুধু একটি রেকর্ডিং স্টুডিও, বসতঘরের একটি কক্ষ। স্টুডিও কক্ষে রক্ষিত আছে রেকর্ডিং সরঞ্জাম। সম্পূর্ণ অধিবেশনের প্রচার-সম্ভার রেকর্ড করে নেয়া হয়।সময়সীমা আড়াই থেকে তিন ঘন্টা।বারোশ ফিটের ৫/৬ টি টেপ। দুজন বাহক নিয়োজিত আছেন। পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। এসে চুপচাপ বসে থাকেন।ব্যাগভর্তি টেপগুলো হাতে নিয়েই দে ছুট। ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বেশ দূরেই ইনস্টল করা হয়েছে। কিন্তু কোথায়?কলকাতা শহরতলিতে? অথবা সেটা কি ‘আকাশবাণী’র কোনো স্পেয়ার ট্রান্সমিটার?
৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো ভারত। সেদিন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামকরণ করা হলো ‘বাংলাদেশ বেতার’। ঢাকা কেন্দ্র চালু হবার পরও চালু ছিলো কলকাতার কার্যক্রম। নাম ছিলো ‘বাংলাদেশ বেতার, মুজিবনগর’।ঘটনাচক্রে শেষের দিনগুলোতে দায়িত্বে মুজিবনগরে থাকতে হলো যাদুমনিকে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২ জানুয়ারি ১৯৭২।২ জানুয়ারি ১৯৭২ রাত নয়টায় একটি রিজার্ভ করা বাসে উঠে যশোর সীমান্ত(বেনাপোল) পেরিয়ে ফরিদপুর হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ৪ জানুয়ারি সকালবেলা রামকৃষ্ণপুর লঞ্চঘাট দিয়ে আরিচা পৌঁছলেন যাদুমনি।
যাদুমনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা সংগঠক। যাদুমনির দুজন প্রাথমিক সহযোগী আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আব্দুল্লাহ আল ফারুক। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে যোগদানকারী অপর ৭ জন সহকর্মী কাজী হাবিব উদ্দিন আহমদ মণি, আমিনুর রহমান, রাশেদুল হোসেন, এ এম শারফুজ্জামান, সৈয়দ আব্দুশ শাকের, মুস্তফা আনোয়ার ও রেজাউল করিম চৌধুরী। এই ১০ জন প্রতিষ্ঠাতা কর্মী নয় মাসব্যাপী সকল পর্যায়ে শব্দ সৈনিকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কালুরঘাটের পর পর্যায়ক্রমে ত্রিপুরার বাগাফা, শালবাগান ও আগরতলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়(মুজিবনগর) বিভিন্ন তরঙ্গ ও শক্তিসম্পন্ন প্রচারযন্ত্র থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন।
সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/এসএম