• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২১ পূর্বাহ্ন

মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ – সাজিদ মোহন

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৬২৮ ৪ ৯
আপডেট: বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০
মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ - সাজিদ মোহন
মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ - সাজিদ মোহন

যাদুমনি তখন ইন্টারমিডিয়েট আর্টস ১ম বর্ষের ছাত্র। কলেজের নোটিশ বোর্ডে একদিন যাদুমনি দেখলেন, একটি বাইরের বিজ্ঞপ্তি সাঁটা রয়েছে।
‘একটি দুর্লভ সুযোগ। একটি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে লাশটি কাটা হবে এবং হাতে কলমে এনাটমির প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সাতদিনের প্রশিক্ষণে যে কোন উৎসাহী শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। এজন্য কোন ফি লাগবে না। বহিরাগত শিক্ষার্থীগণকে স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে এসে নাম নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে।’
যাদুমনির অত্যন্ত আগ্রহ দেখে, কলা বিভাগের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলার অধ্যাপক মোতাহের হোসেন চৌধুরী যাদুমনিকে এনাটমি বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র পাইয়ে দিলেন।
প্রতিদিন প্রায় দুঘন্টা ধরে লাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা-ছেঁড়া দেখা এবং বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষকের লেকচার মন দিয়ে শোনা। সারাক্ষণ নাকে রুমাল জড়িয়ে ছয়দিনের প্রশিক্ষণ শেষে একটা সার্টিফিকেটও পেয়েছিলেন যাদুমনি। সঙ্গে পেয়েছিলেন এক মহান শিক্ষা, জীবন উপলব্ধি। যাদুমনির মনে এসেছিলো, মানবদেহকে কীটের কিংবা আগুনের আহার হতে না দিয়ে যদি শল্য শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য উৎসর্গ করা হয়, সেটাই হতে পারে শেষতম সদ্ব্যবহার।
রমজানের ছুটিতে বাড়িতে এসে যাদুমনির মুখে মরণোত্তর দেহদানের কথা শুনে সবাই চমকে উঠলেন। মেজভাই আরবি ও উর্দু ভাষার পন্ডিত, জবরদস্ত মাওলানা। বললেন, ‘আমরা তো শুনেছিলাম, রক্ত আর চক্ষুদানের কথা।এখন একেবারে সম্পুর্ণ শরীর? না, এসব কিন্তু আমাদের বিধানে নেই।’ যাদুমনি বললেন, ‘অনেক কিছুই তো সেই জমানায় আবিষ্কার হয়নি। সেজন্য বিধান নেই।এখন চিকিৎসাশাস্ত্রের কত উন্নতি হয়েছে।’ মেজভাই এবার রেগে গেলেন। বললেন, ‘এসব যুক্তি তর্ক করে কোন সমাধান হবে না। তাছাড়া তুমি মরে গেলে, তোমার আর কি করার থাকবে? আমরা তখন আমাদের নিয়মেই দাফন কাফন করবো।’

আরো পড়ুনঃ (কবি বেলাল মোহাম্মদের কিশোরপাঠ্য জীবনীর পূর্বের সকল পর্বগুলো )

মেজভাইয়ের পাশেই বসেছিলেন যাদুমনি। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে সরে এসে বড় গলায় বললেন, ‘আপনি আগে মারা যাবেন। আমার ইচ্ছে।।।।। পুরনে বাঁধা দেবার আপনি সুযোগই পাবেন না।’ বলেই ওখান থেকে দে-ছুট।
যাদুমনির সেই কথা আর সত্য হলো না।মেজভাইয়ের আগেই চলে যেতে হল তাকে। দীর্ঘদিন ধরে কিডনীসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন যাদুমনি। ২০১৩ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হঠাৎ করেই যাদুমনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ২৬ জুলাই অবস্থার অবনতি হলে, বিকেল চারটায় যাদুমনিকে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর আ্যাপোলো হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঐ দিনই কলকাতা যাওয়ার কথা ছিলো তার। রাত সাড়ে আটটায় অবস্থার আরো অবনতি হলে যাদুমনিকে নেয়া হয় হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে। অ্যাপোলোর আইসিইউ তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ জুলাই ভোর ৪.১০ মিনিটে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান যাদুমনি।
৩০ জুলাই বায়তুল আমান জামে মসজিদ। প্রাঙ্গনে যাদুমনির প্রথম জানাজা হয়। ৩১ জুলাই সকালে যাদুমনির কফিন নিয়ে যাওয়া হয় দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ বেতারের শাহাবাগ কার্যালয়ে। পৌনে এগারোটায় সেখানে পড়া হয় দ্বিতীয় জানাজা।সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এরপর যাদুমনির কফিন নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে। দীর্ঘদিনের সহকর্মীকে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা। এরপর এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে এই যোদ্ধার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায় উপস্থিত জনতা।
মেজভাইকে বলা কথাটি সত্য না হলেও সেই ১৭ বছর বয়সের প্রশিক্ষণটি সেদিন যাদুমনির মনের মধ্যে যে ইচ্ছে জাগিয়ে দিয়েছিলো তা সত্য হয়েছে মৃত্যুর পর। ১৯৫৩ সালে প্রথমত মুখে বলাবলি করলেও সময়ে সময়ে বিভিন্ন সংস্থাকে ইচ্ছার কথাটি জানিয়েছিলেন যাদুমনি।মৃত্যুর আগে সন্ধানীকে দান করে গেছেন মরণোত্তর চক্ষু আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের কাছে সংরক্ষিত আছে যাদুমনির প্রাণহীন দেহ।
জীবনভর যাদুমনি কোথাও এক ইঞ্চি পরিমান ব্যক্তিগত সম্পত্তির কায়েমি স্বত্ত্বাধিকার উপভোগ করেননি। মৃত্যুর পর তার নামে কেন চার হাত জমি বরাদ্দ হবে?
সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/সাজিদ মোহন ।


Skip to toolbar