• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন

নাতি আমার কবি হবে – সাজিদ মোহন

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৭৫৯ ৪ ৯
আপডেট: বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০
নাতি আমার কবি হবে - সাজিদ মোহন
নাতি আমার কবি হবে

শৈশবেই যাদুমনির মধ্যে এক ধরনের সাময়িক রুপান্তর দেখা যেতো। তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি, হঠাৎ একদিন বড় ভাই দেখলেন, গ্রামের বাড়ির প্রশস্ত উঠানের এক কোনায় পরিষ্কার ও সমতল মাটিতে বাঁশের কঞ্চির আঁকিবুঁকিতে পাশাপাশি অজস্র ঋজুরেখা টেনে যাচ্ছে বেলাল। সেই মুহূর্তে তার গায়ের রং যেন লালচে হয়ে উঠেছে।
বড় ভাই স্পর্শ করে দেখলেন, গা গরম, গায়ে জ্বর। মুখে কিছুই বলছে না। আরও পর যখন অক্ষরজ্ঞান হল, একদিন বড় ভাই আবারও দেখলেন, সাদা কাগজে কয়েকটি অক্ষর বারবার দ্রুত হাতে লিখে যাচ্ছে বেলাল। একই রকম গায়ের রং লালচে, গায়ে জ্বর ও মুখে কথা নেই।
তারপর বর্ণশিক্ষা শেষ হলে দেখা গেলো লেখার খাতায় দুই এক লাইন সমিল পদ্য লেখা শুরু করেছে যাদুমনি। দাদাজি মুন্সি গোলাম মজিদ দেখে বলতেন, নাতি আমার কবি হবে। একটু বড় আকারের পদ্য লেখার পূর্বক্ষণেই ঠিক ঐ রকম রুপান্তর ঘটতো। কবিতাটি শেষ হবার পরই ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাবার মত বেলাল স্বাভাবিক হয়ে যেতো।
কলকাতার সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর একটা পাতা ছিলো ‘ছোটদের মজলিশ’।যাদুমনির কবিতা দাদাজিই প্রথম পাঠালেন ঐ পত্রিকায়। ‘নিরাশ হইনি তবু’ শিরোনামে বারো ছত্রের কবিতাটির শেষ চার ছত্র ছাপা হল ‘আশা তবু’ নামে। যাদুমনির প্রথম মুদ্রিত কবিতা।
‘মন মোর সদা নিরাশ হয় গো নিরাশাকে চায় বরিতে কভু প্রবোধে প্রবোধে কাটাতেছি কাল আজিও নিরাশ হইনি তবু।’
সেটা ছিলো ১৯৪৪ সাল। যাদুমনির বয়স তখন আট, ক্লাস থ্রী থেকে সবেমাত্র ফোর-এ উঠেছে। প্রথম মুদ্রিত না হলেও যাদুমনির লেখা প্রথম কবিতা কিন্তু এটি।
‘আজিকে বন্ধু ফুটেছে ইন্দু আকাশের কোলে লালবর্ণ ঝলিছে স্বর্ণ তারই ছায়াতলে।’
দারুণ ছন্দবদ্ধ এবং শব্দের জ্যেঠামো মন্ডিত। গ্রামের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ‘ইন্দু’ শব্দটি কোথায় পেলো? যাদুমনিকে অনুযুক্ত করার উপায় নেই। পাঠ্য বইয়ের প্রথম কবিতাটিই যে কায়কোবাদের ‘প্রার্থনা’।
‘বিভো দেহ হৃদে বল না জানি ভকতি না নাদি শকতি তোমার আকাশে পূর্নিমার ইন্দু এতো সমুজ্জ্বল’।
ঠিক ঐ সময় ঘটলো আরেক ঘটনা। গোয়াল ঘরে যাদুমনি খুঁজে পেলো আস্ত একটা হাতে লেখা পুঁথি। সামনের দিকের কয়েকটি পাতা নেই।
বাড়িতে যিনি গায়ে খাটুনির কাজ করতেন, সেই মনাফজল কাকু পুঁথির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তামাক জড়িয়ে রাখতেন। দাদাজি দেখেই চিনলেন, ওটা একটা পুঁথি। তবে হাতের লেখা সহজপাঠ্য নয়। যাদুমনির নামে দাদাজি সেটা পাঠালেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ঠিকানায়। কয়েকদিন পরেই এসেছিলো প্রাপ্তি সংবাদ। যাদুমনিকে সম্বোধন করে ড.শহীদুল্লা’র হাতের লেখা চিঠি। ভেবেছিলেন যাদুমনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক।
‘প্রিয় বেলাল মোহাম্মদ, আপনার প্রেরিত বইটি মহাকবি আবদুল হাকিমের ‘নুরনামা’। তিনি সন্দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন।’
তাহলে সন্দ্বীপে একজন মহাকবি ছিলেন!অল্পবয়সে এ খবর যাদুমনিকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছিলো।
১৯৪৭ সাল। যাদুমনির বয়স তখন এগারো। পাঁচ বছরের বয়োজ্যোষ্ঠ সফিনাজ নরুন্নাহার এলেন বাড়ির বড় বউ হয়ে। এসেই তিনি জানতে পারলেন, বেলাল তার তৃতীয় দেবর কবিতা লেখে এবং কলকাতার পত্রিকায় আট বছর বয়সেই তার কবিতা ছাপা হয়েছিলো। সফিনাজ নিজেও এটা সেটা লেখাজোখা করতেন। এভাবেই একই বাড়িতে দুজন লেখক লেখিকা জুটে গিয়েছিলো এবং দুজনে মিলে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ব্যাথার দান’ এর আদলে লিখতে শুরু করলেন একটি পত্র উপন্যাস।
কবিতার মত গান ও নাটকের প্রতিও অগাধ ভালোবাসা ছিলো যাদুমনির। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে ছিলো বেশ বড় একটা কলের গানের বাক্স। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেয়া হতো। কালো গোলাকার রেকর্ড চাপিয়ে দিয়ে তার ওপর পিন আটা লোহার হাতটি বসিয়ে, ঘুর্ণমান ডিস্ক রেকর্ডে পিনের ঘষা লাগলেই গানের শব্দ বেজে উঠত।
গ্রামোফোনে রাখাল বন্ধুর গান, গুনাই বিবির গান, কৃষ্ণলীলার কীর্তনমূলক গান। গৃহকর্মী দেলু বুয়াজি গাইতেন বিয়ের গান আর ভিখারী চেরাগালি নেচে নেচে গাইতেন বিপ্লবী লালমোহন সেনকে নিয়ে প্রচলিত গান।
গ্রামে তখন মেয়ের ভূমিকায় ছেলেকেই অভিনয় করতে হতো। গ্রামের হাটে একবার মঞ্চস্থ হয়েছিলো নাটক ‘খুনী’।অত্যাচারী স্বামীকে খুন করেন একজন স্বাধীনচেতা গ্রামীন নারী। নাটকে সেই নাম ভূমিকায় যাদুমনি শাড়ি পরে অভিনয় করেছিলো মেয়ে সেজে। সেই নাটকে নিজের লেখা ও সুর করা একটি বিরহের গানও লিখেছিলো যাদুমনি। ‘সে যে গেলে আর আসিলে না ফিরে।’
অভিনয়ের জন্য স্কুলে মোটামুটি নাম-ডাক ছিলো তার। জীবনে একবারই অষ্টম শ্রেণীতে শিক্ষকের বেতের মার খেয়েছিলেন, তাও নাটকের জন্য।একরাতে নৌজোয়ান ক্লাবের নাটকে অভিনয় করে চোখে মুখে শুধু রাত জাগার চিহ্নয় নয়, গলায় এবং কানের পাশে লেগেছিলো মেক-আপের কড়া রঙ। প্রধান শিক্ষক হাত দিয়ে ছুঁয়ে পরীক্ষা করে অতঃপর বললেন, হাত পাত।
আরো পড়ুনঃ প্রথম পর্ব-  দশপুরুষের বসতভিটা – সাজিদ মোহন 
১৯৫৩ সাল। যাদুমনি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। কলেজের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে প্রমথনাথ বিশীর ‘ঋনংকৃত্যা’ মঞ্চায়নের ব্যবস্থা নেয়া হলো।অভিনয়ে আগ্রহী ছাত্ররা এসেছে যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য। অধ্যাপক-নির্দেশক বললেন, “যাদের আগের অভিজ্ঞতা আছে, তারা যে কোন মুখস্ত সংলাপ উচ্চারণ করতে পার। এছাড়া কেউ ইচ্ছে করলে টেবিলে রাখা নাটকের যে কোন সংলাপ দেখে দেখেও পাঠ করতে পার।”
যাদুমনিকে দেখে পাঠ করতে হলো না। গ্রামোফোনে শোনা নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কন্ঠে নবাব সিরাজুদ্দৌলার একটি বড়োসড়ো সংলাপ উচ্চকন্ঠে আওড়াচ্ছিলেন। ওদিকে ততক্ষণে হলসুদ্ধ শুরু হয়েছে হাসির রোল। যাদুমনির কিন্তু ওদিকে খেয়াল নেই। সংলাপটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলল হাসি। আর সেই সঙ্গে শেষ হলো অভিনয়ের ইতিহাস।
তবে, গান ছেড়ে যাদুমনি দূরে কোথাও যাননি। কন্ঠশিল্পী ছিলেন না তিনি। তবুও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে আমালটোলার সুফী সাহেবের খনকা শরিফে প্রত্যহ শেষরাতের বৈঠকে একটি করে গান গাইতে হতো তাকে। দীর্ঘ নয় বছর তিনি কাটিয়েছেন খনকা শরীফে। গ্রামোফোনের রেকর্ডে শোনা মারফতি, মুর্শিদি ছাড়াও বহূশ্রুত সুরে নিজের কথা বসিয়ে নতুন স্বরচিত গান। আর সারাক্ষণ গুনগুন করে গাইতেন নিজের প্রিয় গানগুলো; মানুষ মানুষের জন্য, অলির কথা শুনে বকুল হাসে…
১৯৫৪ সালে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত চারদিনব্যাপী প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা এসেছিলেন যাদুমনি। সঙ্গে এসেছিলেন পিঠাপিঠি অগ্রজ হেলাল। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই দুজনে বড় ভাই এ এ এম ইউসুফের সঙ্গে দেখা করতেন।
এক সাক্ষাতে হেলাল বলল, তাদের দুজনের জন্য দুখানা শীতের কম্বল চাদর কিনতে বিশ টাকা লাগবে। দুখানা দশ টাকার নোট হেলালের দিকে বাড়িয়ে দিতেই যাদুমনি দ্রুত নিন্মস্বরে বলল, তার চাদরের টাকা তার হাতে দিতে। পরে বড়ভাই হেলালকে জিজ্ঞেস করলেন, বেলাল কেন অভদ্রের মত সেদিনের টাকারা আলাদা করে নিয়েছিলো? উত্তরে হেলাল বলল, আপনি বুঝতে পারেননি? সে ঐ দশ টাকায় এক ডজন বই কিনেছে।
যাদুমনির প্রথম বই বের হয় ১৯৫৬ সালে, আঠারোটি কবিতার ক্ষুদে সংকলন, ‘কবিতা নয়’। এ বই প্রকাশিত হলে যথার্থ কবি পরিচয় লাভ করেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজে তার প্রত্যক্ষ শিক্ষক অধ্যাপক মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রিয় ছাত্রের কবিতার বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘বেলালের কবিতাগুলো সত্যি কবিতা নয়, কবিতার আঙ্গিকে স্লোগান’। পরে যাদুমনি আরও অনেক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখেছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ছিয়াত্তর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখির জন্য ২০১১ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার।
যাদুমনির বইঃ কবিতা- কবিতা নয়(১৯৫৪), পর্যায়ক্রমিক নেই(১৯৬৯), অকাল অপাত্র(১৯৭৭), শুধু মিত্রাক্ষর(১৯৮১), সামনে আছে মুক্তিযুদ্ধঃ সবার আগে খাদ্য(১৯৮৭), পর্যায়ক্রমিক(১৯৯৫), রবারের খেলা(১৯৯৬), রবিকরে অবিরল(১৯৯৬), এখন বৃষ্টিতে এসিড(১৯৯৮), শাবানার টিয়াপাখি(২০০০), অন্যন্য আত্মজের নামে(২০০০), নির্বাচিত কবিতা(২০০১), অখন্ড উচ্চারন(২০০১), নারি হাসনজান(২০০৩), তীর্থযাত্রার রোজনামচা(২০০৪), শতফুল শতরুপা(২০০৪), লাল মলাট(২০০৫), উপনয়ন(২০০৯), অনুকূলে পলিমাটি(২০০৯), চিত্ররুপা(২০০৯)
শিশুকিশোর সাহিত্য- আর এক মুক্তিযুদ্ধ(১৯৮৬), সাকিন সন্দ্বীপ(১৯৯৪), জয় বাংলা রেডিও(১৯৯৬), বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ(২০০১), আমাদের বিশেষ দিনগুলো(২০০১), বীরশ্রেষ্ঠদের কথা(২০০১), অন্ধ ও খন্জ(২০০১), ছড়াছড়ি(২০০৮), ছোটদের আর এক মুক্তিযুদ্ধ(২০০৮)
গল্পগ্রন্থ- চৌরাশ(২০১০)
স্মৃতিগ্রন্থ- আমানটোলার পয়গাম(১৯৭৪), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র(১৯৮৩), কত ঘরে ঠাঁই(২০১৩), নারীগন(২০১০)
জীবনীগ্রন্থ- অন্তরঙ্গ আলোকে কমরেড মুজফফর আহমদ(২০০১), আমানটোলার সুফী(২০০৫), মরনজয়ী লালমোহন সেন(২০০৪)
প্রবন্ধ- ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার(২০০১), আমার প্রতিবাদের ভাষা(২০০৪), গল্পের মত(২০১০)
অনুবাদ- শয়তান-কাহলিল জিবরান(১৯৮৬)
সম্পাদনা- সন্দ্বীপ সন্দর্শন(১৯৬৯), কমরেড মুজফফর আহমেদ(১৯৭৪)
ভ্রমণ- যেতে যেতে পথে(২০০১)
সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/এসএম


Skip to toolbar