• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৫৬৬ ৪ ৯
আপডেট: বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার
ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার

কৈশরে যাদুমনির বন্ধু ছিলেন নব্বুই বছরের বুড়ো দাদাজি মুন্সি গোলাম মজিদ। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে মুন্সি যাদুমনিকে কাছে ডাকতেন।কোল ঘেষে বসতে হতো দাদাজির। শক্ত মলাটের বাঁধাই একটা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে নাতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুন্সি বলতেন, ‘পড় দেখি, শব্দ করে পড়। আমি শুনি।’
সেটা ছিলো বড়দের বই। ইমাম গাজ্জালির ‘কিমিয়ায়ে শাহাদাত’ এর বাংলা অনুবাদ ‘সৌভাগ্য স্পর্শমনি’।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রের জন্য বইটি দারুণ দাঁতভাঙ্গা। যুক্তাক্ষর কিংবা বিদেশি ভাষার শব্দস্থানে হোঁচট খেয়ে খেয়ে শুধু বানান করে পড়ে যেতো যাদুমনি। পড়তে পড়তে হঠাৎ যাদুমনি দেখলো, এক জায়গায় লেখা আছে সাতটি গ্রহের কথা।
সাতটি কেন? স্কুলের বইতে লেখা আছে নয়টি গ্রহ। দাদাজিকে প্রশ্ন করল যাদুমনি। মুন্সি নিজের চোখে দেখলেন। তারপর ভাবলেন কিছুক্ষণ। বললেন, ‘ঠিকই আছে। ব্যাপারটা হলো, ইমাম গাজ্জালি তো কয়েকশ বছর আগের মানুষ। ঐ সময় সাতটি গ্রহের কথাই সবাই জানতো। নেপচুন আর প্লুটো হালে আবিষ্কার হয়েছে।’
সে মুহূর্তে খুব উত্তেজিত, ছোঁ মেরে দাদাজির হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল যাদুমনি। তারপর ছুঁড়ে মারল মেঝেতে।বলল, ‘তবে তো বৈজ্ঞানিকরাই বেশি জানে। ধর্মের কথা সব ‘পচা’।’
সকল সংস্কারকই আমাদের শ্রদ্ধেয়।যাদুমনি বলতেন, যার যার দেশকালে তারা মানবতার কল্যাণ করতে চেয়েছেন।অতীতের সংস্কারকদের মতাদর্শকে যার যার দেশকালের উপযোগিতার নিরিখে সসন্মানে বিবেচনা করা না গেলে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা হবে এবং এতে জ্ঞানবিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার ধারাবাহিকতাও ক্ষুন্ন হবে।
ধর্ম নিয়ে ছোটবেলায় যাদুমনি করে বসেছিলেন আরেক ‘অপরাধ’! পাশের বাড়ির দাদু মারা গেলেন। কবর দেয়া হলো পুকুর পাড়ে। কবরের পাশে একচালা বেঁধে চারজন মৌলভী মাদুর পেতে শুরু করলেন সুরেলা কোরআন পাঠ।
সন্দ্বীপ মাদ্রাসায় ভর্তি হতে সাহাবাজপুর থেকে ঐ সময় একজন তালেব এলেম এসে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন যাদুমনিদের বাড়িতে। একান্তে যাদুমনিকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, ওই যে মৌলভী সাহেবেরা কবরের পাড়ে বসে কোরআন তিলওয়াত করছেন, এটা কিন্তু না জায়েজ।’ তারপর শামি কিতাবের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘সেই কিতাবের পঞ্চম জিলদ-এ কথাটা উল্লেখ আছে।’
তারপর যাদুমনি করলো কি, এক টুকরো কাগজ নিয়ে তাতে লিখলো, এই যে হুজুরান, আপনারা কি করছেন?আপনারা কি জানেন না, শামি কিতাবের পঞ্চম জিলদ-এ লেখা আছে, কবরের পাড়ে বসে কোরান পড়া হারাম। নিচে কোন নাম স্বাক্ষর নেই। টুকরো কাগজটি নিয়ে অনেক্ষণ ঘুরঘুর করলো যাদুমনি।তারপর এক ফাঁকে মৌলভীদের চোখ এড়িয়ে একচালার খুঁটিতে কাগজটি গেঁথে দিয়ে আস্তে করে সরে পড়ল।
যাদুমনির কাছে ধর্ম মানে নিজে বাঁচা এবং অন্যকে বাঁচতে দেয়া। এমনি একটি সুস্থ ও সার্বজনীন ধর্মীয় দেশ পরিমন্ডল গড়ার জন্য কাঙ্খিত হচ্ছেন একজন সর্বংসহা মাতৃময়ী গৃহকর্ত্রী, যিনি প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা কে কোন ভজনালয়ে গেল না-গেল, তার তোয়াক্কা রাখেন না।বরং ভোজনালয়ে যথাসম্ভব সমবন্টনকেই মান্য করেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে। এবং ঘরে ঘরে মায়েদের মত সব সন্তানের অন্নপান পরিবেশনের পর উদ্বৃত্তটুকু নিজে গ্রহন করেন।
যাদুমনিকে নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিলো না মায়ের। কেন তার এই ছেলেটি নামাজি হলো না। মায়ের মধ্যে আবার একটা স্ববিরোধিতাও ছিলো। একদিন শুক্রবার যাদুমনিকে ডেকে বললেন, ‘আজ তো জুম্মাবার। তুমি কি মসজিদে যাবে?’ যাদুমনি বলল, ‘না।’ মা বললেন, ‘যাওয়া না যাওয়া তোমার ব্যাপার। যদি মসজিদে না যাও, নাস্তা খেয়ে এখনি তোমার কোন বন্ধুর বাড়িতে চলে যাও। বিকেলে ফিরে এসো। বাড়িতে আছ, অথচ জুম্মার নামাজে যাচ্ছ না, এটা গ্রামের সবাই জানবে। তখন তোমার আব্বার বদনাম হবে।’
যে কোন বিশ্বাস বা অবিশ্বাসই এক-একজন মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটাই ছিলো যাদুমনির বিশ্বাস। পিতৃপুরুষের বিশ্বাসকে তিনি জোড় করে আত্মজদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইতেন না। সাময়িক নিরাপত্তার কথা ভেবে শিশুর মধ্যে মা যেমন ‘ভূতের ভয়’ সংক্রামিত করেন এবং জীবনের জন্য তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ঠিক একই নিয়মে ভীতসন্ত্রস্তদের দলই ভারী হচ্ছে। যাদুমনি বলতেন, এতে শুধু ধার্মিক নামধারীদের সংখ্যা বাড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে আদর্শের অনুশীলন আর আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব হয়ে পড়ছে মানব জীবন।
দীর্ঘ ন’বছর সুফী সাহেব একান্ত যাদুমনির সঙ্গে কোনদিন নিতান্তই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক আচার অনুশাসন সম্পর্কে কিছুই বলেননি। তবে একদিন কথা উঠেছিলো। যাদুমনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ধর্মের আধ্যাত্মিক দিকই নাকি এক?’ সুফী সাহেব বললেন, ‘নিশ্চয়। ঐ যে রাম কৃষ্ণের প্রার্থনা, ‘আমায় দে মা পাগল করে’ আর আমার ‘আল্লা রসুলের মহব্বত চাই’- এই দুইয়ের মধ্যে আদতে কোন পার্থক্য নেই।’ সুযোগ বুঝে যাদুমনি বললেন, ‘আপনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘কমুনিস্টগিরী’ শেখাবেন। সব মানুষের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে আর প্রয়োজন অনুযায়ী জীবিকার সামগ্রী পাবে, এমন ব্যবস্থা কি করা যাবে?’ সুফী সাহেব বললেন, ‘ইসলামের খলিফা ‘ফোরাতের তীরে’ অভুক্ত কুকুরটির জন্যও নিজেকে দায়ী করেছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরই তো সবার আগে বলেছিলেন, যার লাঙ্গল তার মাটি।’


Skip to toolbar