• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন

অমল ধবল চাকুরী – সাজিদ মোহন

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৫৬৪ ৪ ৯
আপডেট: শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বেলাল মোহাম্মদ
বেলাল মোহাম্মদ

সুফী সাহেবের মৃত্যুর পর যাদুমনি ( বেলাল মোহাম্মদ ) কিছুটা সমস্যায় পরেন। শেষ রাতের বৈঠকে সুফী সাহেব যাদুমনিকে রোজ যে একটি করে টাকা হাত খরচার জন্য দিতেন তা এখন বন্ধ। আর ঠিক তখনি মিঠাছড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে প্রস্তাব এলো যাদুমনির কাছে। স্কুলের বাংলা শিক্ষক সড়ক দূর্ঘটনায় আহত। বছরের শেষ দুই মাস যাদুমনি যদি তার স্কুলে শিক্ষকতা করে, তাহলে তাদের বাংলা শিক্ষকের শুন্য পদটি পুরন হবে।

শিক্ষকতা যাদুমনি ( বেলাল মোহাম্মদ ) আগেও করেছিলেন। তাও মাত্র দুই মাস।মুছাপুর মিডল ইংলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছুটিতে থাকায় ক্লাস ফাইভ ও সিক্সে তার বিষয়গুলো যাদুমনিই পড়াতেন।
তবে শিক্ষকতা যাদুমনির প্রথম চাকুরী ছিলো না। তারও আগে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর থেকে ফল বের হবার আগ পর্যন্ত তিন মাস যাদুমনি ঢাকা ছিলেন। ঢাকার বংশাল রোডে ছিলো দৈনিক ইনসাফের অফিস। পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সন্দ্বীপের মাওলা চৌধুরী। প্রথম দিন দেখা করেই যাদুমনি বললেন, আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি, কবিতা লিখতে পারি। আমি সাংবাদিক হতে চাই।
মাওলা চৌধুরী যাদুমনির হাতে দিলেন আ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্থানের (এপিপি) একটি ছোট টেলিপ্রিন্টার কাটিং। কাগজ ও কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই সংবাদটি বাংলায় অনুবাদ কর দেখি। সেদিনের তৈরী করা তিন/চারটি ছোট ছোট সংবাদ পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। সেই আইটেমগুলোতে টিক চিহ্ন দিয়ে মনের আনন্দে চেনা জানা সবাইকে দেখিয়েছিলেন যাদুমনি। পরের দিনও ঠিক একই কাজ করলেন যাদুমনি। তবে ডেস্কে বসে।
মাওলা চৌধুরী যাদুমনিকে সহজ ও ছোট ছোট আইটেমগুলো বাছাই করে দিতেন। তিন মাস পর যাদুমনি চট্টগ্রাম চলে এলেন। ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম কলেজে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ১৯৫২-১৯৫৪ প্রায় দেড় বছর যাদুমনি চাকুরী করেছেন দৈনিক আজান পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে।
খনকা শরীফ ত্যাগ করে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে সস্ত্রীক যাদুমনি ( বেলাল মোহাম্মদ ) সন্দ্বীপ চলে গেলেন। আসিয়াকে সন্দ্বীপ রেখে কর্মজীবনের অনির্দিষ্ট এক ভবিষ্যতকে সামনে নিয়ে আবার চট্টগ্রাম এলেন যাদুমনি। এসেই প্রথম গেলেন দৈনিক আজাদী অফিসে। বললেন, আমি এসেছি চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।আমার চাকুরী প্রয়োজন। মোহাম্মদ খালেদ তখন পত্রিকার সম্পাদক।এপিপি’র একটি নিউজ স্লিপ যাদুমনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, বেশ তো, এই শুরু করুন কাজ। এই মুহূর্ত থেকে আপনার চাকুরী। কিন্তু সুফী সাহেব যে যাদুমনিকে বলেছিলেন রেডিওতে যোগ দিতে। তার কি হবে?
মাত্র তিনমাস দৈনিক আজাদীতে শিক্ষানবীশ সহ-সম্পাদকের কাজ করলেন যাদুমনি। এবং যেদিন বিকেলে আপন মনে সে চাকুরীর ইস্তফা দিয়ে এলেন, ঠিক তখনই পার্সিভিল হিলের ভাড়াটে বাড়ির দরজায় চট্টগ্রাম বেতারের এক পত্রবাহকের সঙ্গে দেখা। যাদুমনিকে তিনি একটি চুক্তিপত্র দিলেন এবং বেতারের একজন অফিসার নুরুন্নবী খানের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরদিন দেখা হলে নুরুন্নবী খান জানালেন, স্থানীয় পত্রিকায় লেখা দেখে তিনি যাদুমনিকে আবিষ্কার করেছেন।
নিজস্ব লেখক শিল্পী হিসেবে বেতারে শুরু হলো যাদুমনির নতুন চাকুরী জীবন।আশরাফ-উজ-জামান তখন চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক। দেখা হবার প্রথম দিনই যাদুমনিকে বললেন, পরনের কাপড় পাল্টাতে হবে।মানে, যাদুমনির লুংগি ফতোয়া। যাদুমনি বললেন, কেন? দেশের সব মানুষই তো এই পোশাক পরেন।
যাদুমনির সাহস আর সততা দেখে মুগ্ধ হলেন আশরাফ-উজ-জামান। অন্য কিছু না, শুধু মৃদু আপত্তি তুলে যাদুমনির সাহসকেই উস্কে দিয়েছিলেন তিনি। বেতারে দীর্ঘ উনত্রিশ বছর চাকুরী করেছেন যাদুমনি। দীর্ঘ চাকুরী জীবনে আশরাফ-উজ-জামানের অভিভাবকত্ব যেমন ছিলো গৌরবের ঠিক তেমনি ফখরুজ্জামান চৌধুরী নামের এক লোকের (প্রধান কার্যালয়ের উপপ্রধান ও প্রধান কর্মকর্তা) দ্বারা বারবার অপদস্ত হয়েছিলেন যাদুমনি।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী যখন যোগদান করেন তার আগেই বদলির হিড়িকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে সহকারী পরিচালক পদে একজনমাত্র যাদুমনিই পদস্ত ছিলেন। তাই তার বদলিও একপ্রকার অবধারিত ছিলো। আনন্দ তখন প্রাইমারিতে।
কয়েকমাস আগে ১৯৭৫ এর নভেম্বরে স্ত্রী বিয়োগ হওয়ায় আনন্দকে নিয়ে যাদুমনি খুব বিপদে পড়ে গেলেন। ফখরুজ্জামান চৌধুরীকে বললেন, স্যার, আমি অন্যত্র বদলি হওয়ার জন্য তৈরী হয়েই আছি।তবে ডিসেম্বরের আগে যেন যাদুমনির বদলির অর্ডার না আসে। সদ্য মা হারা ছেলেটির বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যাওয়া অনেক অসুবিধা হয়ে যাবে।
কেন জানি যাদুমনিকে খুব ঈর্ষা করতো লোকটি। বহূ পান্ডুলিপি নিজে লিখে বেনামে প্রচার করে অর্থ আত্মসাৎ, কর্তৃপক্ষের প্রতি অনানুগত্য, তথাকথিত ক্ষমতার অপব্যবহারের বানোয়াট ফিরিস্তি। সে চিঠি লিখলো মহাপরিচালকের কাছে। ফলে যাদুমনির বদলির নির্দেশ এসে গেলো আরও তাড়াতাড়ি।
১৯৭৬ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে যাদুমনিকে বদলি করে পাঠানো হলো সিলেট। ১৯৮২ সালে বদলি হয়ে ঢাকায় না আসা পর্যন্ত এই অর্ধযুগ যাদুমনি সিলেটেই ছিলেন।
দীর্ঘ ২৯ বছরের কর্মজীবন অতটা সুখের ছিলো না যাদুমনির। দপ্তরে একদিনও দেরী না করার বিষয়টি মূল্যায়ন করেনি কেউ। বরং ১৯৯৩ এ অবসর নেবার আগে একটি পদোন্নতি ও ভূতাপেক্ষা বারোটি ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিদায় সংবর্ধনায় সহকর্মীরা এ নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। যাদুমনি বলেছেন, এতে শুধু আমার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তার মানে Nothing is lost. কিন্তু এটুক করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনেরা সত্যের অবমাননা করেছেন, নিজেদের চরিত্র নষ্ট করেছেন। They have lost everything.
সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/এসএম


Skip to toolbar