মিরসরাই ইষ্টিশন। ট্রেনে, চট্টগ্রাম থেকে দুই ঘন্টার রাস্তা। নেমেই সোজা পশ্চিমের পথ ধরে এগিয়ে আসতে হয় দেড় মাইল পথ। যাত্রীদের একটা অংশ; যা চলতে থাকে পুন্যময় এক কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে, এখানকার এক গ্রামে। গ্রামের নাম আমানটোলা ।
আঠারো বছরের রোমান্টিক নাস্তিকতার ধারা প্রবাহমান যাদুমনির উপর দিয়েও । রাজনৈতিক হুজুগী তার মান । ঠিক এমন সময় চুয়াত্তুরে এক বুড়োর জীবন বড় অবাক করে দিলো তাকে। টানা ত্রিশ বছর ইনি এমন একটি লঙ্গরখানা চালনা করেন, যেখানে নিয়মিত শতাধিক মেয়ে পুরুষের বসবাস। এবং আসা যাওয়ায় রয়েছে এমন লোকজনসহ দুবেলা দুশ মানুষের প্রত্যহ খাবার ব্যবস্থা।
কী আশ্চার্য! ইনি নিজ হাতে প্রত্যহ পাঁচশ লোকের খাবার পরিবেশন করেন এবং নিজে সারাদিন উপোস থাকার পর, রাতে সকলের খাওয়া শেষে হাড়ির তলা থেকে কুড়িয়ে নেয়া দু-তিন গ্রাস ভাত খেয়ে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য নেন উপোস থাকার প্রস্ততি। জীবনের গত চল্লিশ বছর ধরে ওনার নামাজ কাযা হয়নি। গত চল্লিশ বছর তিনি জলপান করেননি, তিনি ঘুমাননি।
চিররোগ হার্নিয়ার বেল্ট পরে সারাদিন পরিশ্রম করেন, নিজের প্লেটখানি নিজের হাতেই ধুয়ে রাখেন। সারাদিনই তিনি কাঁদেন। সবচেয়ে ছোট যারা আসেন, তাদের কাছেও তিনি বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন, আমি কিছু জানি না। এই সুফী সাহেব হুজুরের সঙ্গে যাদুমনির আব্বার খুব সখ্য। একবার যাদুমনির জন্য হুজুরের কাছে খাস দোয়া চাইলেন তিনি। “যাদুমনি, তার চতুর্থ পুত্র নাস্তিকদের দলে ভিড়েছে ।”
সুফী সাহেব বললেন, আল্লাকো ইয়াদ কর আর ঐ ছেলেকে একবার আমার কাছে নিয়ে আস । আব্বা বললেন, আমার সাধ্য কি, আপনি আকর্ষণ করলে সে অমনি আসবে। কোনোভাবে আকৃষ্ট হয়ে কিনা কে জানে, সেচ্ছায় আব্বাকে জানিয়ে এবং আব্বার দেয়া পাঁচ টাকা স্বতঃস্বেচ্ছ গদী সেলামী দিয়ে সুফী সাহেব হুজুরের সঙ্গে মোলাকাত করলেন যাদুমনি।
ইয়া লম্বা লম্বা চুল যাদুমনির। সুফী সাহেব বললেন, ইভা কন্ রে! ইভা তো ফইর । মার্চ-এপ্রিল-মে-জুন। চারমাস কেটে গেলেও যাদুমনির ফেরার কোন নাম নেই । ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আব্বা অগত্যা চিঠি পাঠালেন মৌলানা নাজির আহমেদের কাছে । লিখলেন, বেলালকে আমরা উকিল রুপে দেখতে চাহিয়াছিলাম । ও যে কি মনে করিয়া এতোদিন ওভাবে ওখানে থাকিয়া গেলো। এবং অনুরোধ করলেন, উনি যেন ইন্টারমিডিয়েটে যাদুমনির পুনঃপরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন।
এই কথা হুজুরের কানে গেলো। সুফী সাহেব বললেন, ম্যাট্রিক পাশ হলে তো মোক্তারী করা যায়, ওকালতি না পড়ে বেলাল বরং মোক্তারী পড়তে পারে। কিন্তু আব্বা চিন্তা করছিলেন, যাদুমনি ওখানে কি করবে, কোন পথে যাবে।
হুজুর বললেন, ও সেই কথা। তা খারাপ কাজ তো কিছু করতে পারবে না। আমি ওর পেছনে আছি । খারাপ কিছু করতে দেখলেই পেছন থেকে টেনে ধরে রাখবো । এরপর আর কথা বাড়াবার অবকাশ ছিলো না। যাদুমনি সেখানেই থেকে গেলেন
দুপুরে খাবার পরিবেশনের পর সুফী সাহেব গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধের সঙ্গে প্রতিদিন সদালাপে বসেন । একদিন এমন সময় হুজুরের ডাক পড়লো। যাদুমনি আশ্চার্য হয়ে দেখলো, হুজুরের হাতে তার সদ্য প্রকাশিত কবিতার বইখানি ‘কবিতা নয়’। ভাষা আন্দোলনের উপরে লেখা কয়েকটি এবং অন্যান্য বিপ্লবাত্মক ভাবধারায় লেখা ছোট একটি বই ।
‘কি মিয়া, ‘কমনিস্টগিরী’ কর বুঝি? কিন্তু কি তোমরা করতে পার, আমাকে বল দেখি । খালি মিটিন-ফিটিনে চেয়ার টানাটানি আর ভাত চাই, কাপড় চাই বুলিই তো আওড়াতে পার । ভাত দিতে পেরেছ এখনো?
তারপর হুজুর বললেন, আমিও একজন ‘কমনিস্ট’ -মানুষের অনেক ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি আজীবন । ঠিক হ্যায়, আগে আমার কাছে তালিম নিয়ে যাও, পরে ‘কমনিস্টগিরী’ কর । কেমন!’
এমন অনন্য ক্লাইম্যাক্স যাদুমনির জীবনে আর কখনো সৃষ্টি হয়নি । শুধু চিন্তা হয়েছে যাদুমনির, নিজেকে সম্পুর্ন তৈরী না করে কোন কাজে নেমে পড়াই অনধিকারচর্চা । সুফী সাহেবের সান্নিধ্যে কেটে গেলো আরও অনেক দিন।
১৯৫৭ সালের প্রথম চতুরাংশে সুফী সাহেবের একক বিবেচনায় নিতান্তই অনিচ্ছা এবং আত্মরক্ষার সম্ভাব্য সব রকমের চেষ্টা সত্ত্বেও যাদুমনির বিয়ে হয় । প্রধান খাদেম আমিনুল হকের মেয়ের সঙ্গে যাদুমনির পরিনয় ঘটিয়ে সুফী সাহেব যাদুমনিকে নিজের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে গ্রাহ্য হবার পরিবেশ সৃষ্টি করলেন ।
বিবাহোত্তর পঞ্চম বর্ষেও কোন সন্তানের পিতৃত্ব অর্জনের লক্ষন না দেখে সুফী সাহেব একদিন যাদুমনিকে ডাকলেন । বললেন, “প্রথম বয়সে এক দুটি ছেলেমেয়ে হলেই ভালো, ওদেরকে লালনপালনের সময় পাওয়া যায়।” সুফী সাহেবের দৃষ্টিতে যতো ঔদার্য-ই থাকুক বাস্তবে এ বাড়িটির মালিক তার ছেলেরা, তাদের সন্তানেরা । অনেকের মত যাদুমনিও এখানে একজন আশ্রিত মাত্র। যাদুমনি ভাবলেন, এ অবস্থায় তার ঐরশজাতক সন্তানের জন্য এই পরিবেশ সন্মানজনক নাও হতে পারে ।
চাইলেন, পরবর্তী জীবনে ভাড়াটে ঘর কিংবা দরিদ্র কুটিরেই যেন তার সন্তানের জন্ম হয় । অবোধ শিশুটি বড় মন নিয়ে বেঁচে বেড়ে উঠতে পারবে । যাদুমনির এ কথায় সুফী সাহেব কেঁদে ফেললেন। এবং সে দিন শেষ রাতের বৈঠকে বললেন, আজ বেলাল আমাকে এমন একটা কথা বলেছে, আমি জব্দ হয়ে গেছি। জ্ঞানী ছেলে তো ।