শৈশবেই যাদুমনির মধ্যে এক ধরনের সাময়িক রুপান্তর দেখা যেতো। তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি, হঠাৎ একদিন বড় ভাই দেখলেন, গ্রামের বাড়ির প্রশস্ত উঠানের এক কোনায় পরিষ্কার ও সমতল মাটিতে বাঁশের কঞ্চির আঁকিবুঁকিতে পাশাপাশি অজস্র ঋজুরেখা টেনে যাচ্ছে বেলাল। সেই মুহূর্তে তার গায়ের রং যেন লালচে হয়ে উঠেছে।
বড় ভাই স্পর্শ করে দেখলেন, গা গরম, গায়ে জ্বর। মুখে কিছুই বলছে না। আরও পর যখন অক্ষরজ্ঞান হল, একদিন বড় ভাই আবারও দেখলেন, সাদা কাগজে কয়েকটি অক্ষর বারবার দ্রুত হাতে লিখে যাচ্ছে বেলাল। একই রকম গায়ের রং লালচে, গায়ে জ্বর ও মুখে কথা নেই।
তারপর বর্ণশিক্ষা শেষ হলে দেখা গেলো লেখার খাতায় দুই এক লাইন সমিল পদ্য লেখা শুরু করেছে যাদুমনি। দাদাজি মুন্সি গোলাম মজিদ দেখে বলতেন, নাতি আমার কবি হবে। একটু বড় আকারের পদ্য লেখার পূর্বক্ষণেই ঠিক ঐ রকম রুপান্তর ঘটতো। কবিতাটি শেষ হবার পরই ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাবার মত বেলাল স্বাভাবিক হয়ে যেতো।
কলকাতার সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর একটা পাতা ছিলো ‘ছোটদের মজলিশ’।যাদুমনির কবিতা দাদাজিই প্রথম পাঠালেন ঐ পত্রিকায়। ‘নিরাশ হইনি তবু’ শিরোনামে বারো ছত্রের কবিতাটির শেষ চার ছত্র ছাপা হল ‘আশা তবু’ নামে। যাদুমনির প্রথম মুদ্রিত কবিতা।
‘মন মোর সদা নিরাশ হয় গো নিরাশাকে চায় বরিতে কভু প্রবোধে প্রবোধে কাটাতেছি কাল আজিও নিরাশ হইনি তবু।’
সেটা ছিলো ১৯৪৪ সাল। যাদুমনির বয়স তখন আট, ক্লাস থ্রী থেকে সবেমাত্র ফোর-এ উঠেছে। প্রথম মুদ্রিত না হলেও যাদুমনির লেখা প্রথম কবিতা কিন্তু এটি।
‘আজিকে বন্ধু ফুটেছে ইন্দু আকাশের কোলে লালবর্ণ ঝলিছে স্বর্ণ তারই ছায়াতলে।’
দারুণ ছন্দবদ্ধ এবং শব্দের জ্যেঠামো মন্ডিত। গ্রামের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ‘ইন্দু’ শব্দটি কোথায় পেলো? যাদুমনিকে অনুযুক্ত করার উপায় নেই। পাঠ্য বইয়ের প্রথম কবিতাটিই যে কায়কোবাদের ‘প্রার্থনা’।
‘বিভো দেহ হৃদে বল না জানি ভকতি না নাদি শকতি তোমার আকাশে পূর্নিমার ইন্দু এতো সমুজ্জ্বল’।
ঠিক ঐ সময় ঘটলো আরেক ঘটনা। গোয়াল ঘরে যাদুমনি খুঁজে পেলো আস্ত একটা হাতে লেখা পুঁথি। সামনের দিকের কয়েকটি পাতা নেই।
বাড়িতে যিনি গায়ে খাটুনির কাজ করতেন, সেই মনাফজল কাকু পুঁথির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তামাক জড়িয়ে রাখতেন। দাদাজি দেখেই চিনলেন, ওটা একটা পুঁথি। তবে হাতের লেখা সহজপাঠ্য নয়। যাদুমনির নামে দাদাজি সেটা পাঠালেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ঠিকানায়। কয়েকদিন পরেই এসেছিলো প্রাপ্তি সংবাদ। যাদুমনিকে সম্বোধন করে ড.শহীদুল্লা’র হাতের লেখা চিঠি। ভেবেছিলেন যাদুমনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক।
‘প্রিয় বেলাল মোহাম্মদ, আপনার প্রেরিত বইটি মহাকবি আবদুল হাকিমের ‘নুরনামা’। তিনি সন্দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন।’
তাহলে সন্দ্বীপে একজন মহাকবি ছিলেন!অল্পবয়সে এ খবর যাদুমনিকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছিলো।
১৯৪৭ সাল। যাদুমনির বয়স তখন এগারো। পাঁচ বছরের বয়োজ্যোষ্ঠ সফিনাজ নরুন্নাহার এলেন বাড়ির বড় বউ হয়ে। এসেই তিনি জানতে পারলেন, বেলাল তার তৃতীয় দেবর কবিতা লেখে এবং কলকাতার পত্রিকায় আট বছর বয়সেই তার কবিতা ছাপা হয়েছিলো। সফিনাজ নিজেও এটা সেটা লেখাজোখা করতেন। এভাবেই একই বাড়িতে দুজন লেখক লেখিকা জুটে গিয়েছিলো এবং দুজনে মিলে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ব্যাথার দান’ এর আদলে লিখতে শুরু করলেন একটি পত্র উপন্যাস।
কবিতার মত গান ও নাটকের প্রতিও অগাধ ভালোবাসা ছিলো যাদুমনির। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে ছিলো বেশ বড় একটা কলের গানের বাক্স। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেয়া হতো। কালো গোলাকার রেকর্ড চাপিয়ে দিয়ে তার ওপর পিন আটা লোহার হাতটি বসিয়ে, ঘুর্ণমান ডিস্ক রেকর্ডে পিনের ঘষা লাগলেই গানের শব্দ বেজে উঠত।
গ্রামোফোনে রাখাল বন্ধুর গান, গুনাই বিবির গান, কৃষ্ণলীলার কীর্তনমূলক গান। গৃহকর্মী দেলু বুয়াজি গাইতেন বিয়ের গান আর ভিখারী চেরাগালি নেচে নেচে গাইতেন বিপ্লবী লালমোহন সেনকে নিয়ে প্রচলিত গান।
গ্রামে তখন মেয়ের ভূমিকায় ছেলেকেই অভিনয় করতে হতো। গ্রামের হাটে একবার মঞ্চস্থ হয়েছিলো নাটক ‘খুনী’।অত্যাচারী স্বামীকে খুন করেন একজন স্বাধীনচেতা গ্রামীন নারী। নাটকে সেই নাম ভূমিকায় যাদুমনি শাড়ি পরে অভিনয় করেছিলো মেয়ে সেজে। সেই নাটকে নিজের লেখা ও সুর করা একটি বিরহের গানও লিখেছিলো যাদুমনি। ‘সে যে গেলে আর আসিলে না ফিরে।’
অভিনয়ের জন্য স্কুলে মোটামুটি নাম-ডাক ছিলো তার। জীবনে একবারই অষ্টম শ্রেণীতে শিক্ষকের বেতের মার খেয়েছিলেন, তাও নাটকের জন্য।একরাতে নৌজোয়ান ক্লাবের নাটকে অভিনয় করে চোখে মুখে শুধু রাত জাগার চিহ্নয় নয়, গলায় এবং কানের পাশে লেগেছিলো মেক-আপের কড়া রঙ। প্রধান শিক্ষক হাত দিয়ে ছুঁয়ে পরীক্ষা করে অতঃপর বললেন, হাত পাত।