• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:১৭ অপরাহ্ন

২৯ শে এপ্রিল ! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৬৬৮ ৪ ৯
আপডেট: বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০
২৯ শে এপ্রিল! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।
২৯ শে এপ্রিল! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।

২৮ শে এপ্রিল ১৯৯১ বিকাল ৪টা । ও আর নিজাম রোডের আমার শ্বশুরের বাসার ডাইনিং টেবিলে আমি, মুকুল আর আরিফুল ইসলাম (ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত,সুবক্তা,খান বাহাদুরের বাড়ীর)। এ্যাডভোকেট আরিফ তখন আমাদের বাসায় প্রতিদিনের মেহমান। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এক/দুই তারিখে । আমাদের বাসায় সব আয়োজন । ওর গায়ে হলুদের ডালাকুলা কিনে আনা হয়েছে ওগুলো রেডি করছিলাম। আর ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আলাপ। তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না ঘূর্ণিঝড় নিয়ে। কিছু হবে না দুর্বল হয়ে যাবে। রাত ৮টা আমার আব্বা (মজিবুল মাওলা) ফোন দিয়ে বললেন, ”আমি গাড়ী পাঠাচ্ছি সামীম (আমার স্বামী) ঢাকা থেকে কতক্ষনে এসে পৌঁছাবে ঠি ক নেই বাচ্চাদের নিয়ে চলে আয় রাতে তুফান শুরু হবে।” আমি বললাম আব্বা এত চিন্তা কর না কিছু হবে না।আমার মা তখন সন্দ্বীপ। বাবা বারবার ফোন করছে যাওয়ার জন্য। পরে আমি আমার দুই ছেলেকে নিয়ে আব্বার চিন্তা দুর করার জন্য আব্বার বাসায় চলে গেলাম ।

তখন মোবাইল ছিলনা। সামীম কয়টায় আসবে জানিনা। রাত আস্তে আস্তে বাড়ছে। আমার আব্বা ভয়ে আমার দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ড্রইংরুমে বসে আছে। সাথে আমি,আ মার বোন(ঝুমু)আর আমার ভাই(বাবু)। বাতাস অতটা নেই আকাশ রক্তের মত লাল হয়ে দম ধরে আছে । মনে হচ্ছে আকাশে আগুন জ্বলছে। ভয়ানক রুপ প্রকৃতির ।

আরো পড়ুনঃ  করোনার একি কাল !! 

রাত বাড়ছে, বিভীষিকাময় সেই রাত । ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেছে । মনে হচ্ছে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে । কারেন্ট নেই, অন্ধকারে মনে হচ্ছে কেয়ামত ।২৫৫ কিলোমিটার বেগে ২০ ফুট উচ্চতায় জ্বলেচ্ছাস ।

রাত ১২ টায় আঘাত হানল ঘূর্ণিঝড় রুপধারী ভয়ানক হ্যারিকেন । চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় এলাকা তছনছ করে দিল।চট্টগ্রাম,কক্সবাজার,মহেশখালী,সন্দ্বীপ,হাতিয়া,ফেনী,পঠুয়াখালী,বরিশালসহ ১৩ টি জেলার ৭৪ টি উপজেলা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল । দেড় লাখের বেশী মানুষ,লক্ষ লক্ষ গবাদীপশু,ফসল,বিপুল স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেল।

সকাল হল। চারিদিক বিধ্বস্ত । মায়ের জন্য অনেক খারাপ লাগছে । কোন খবর পাচ্ছি না । তখনও জানিনা সন্দ্বীপের কি করুণ পরিণতি ।

সামীম রাতে এসে ওদের বাসায় পৌঁছেছে । ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার সময় একটা টর্চ কিনে নিয়েছিল । Ctg পৌঁছানোর পর যদি কারেন্ট না থাকে । বাসায় বাচ্চু (আমার দেবর আহসান জামীল) ছিল না । ওকে নিয়ে কানের চিকিৎসার জন্য আমার শ্বশুর কলকাতায় গেছেন। বাসায় শুধু মুকুল(আমার চাচাতো দেবর, মোয়াজ্জেম কাকার ছেলে) রাতে সামীম এসে পৌঁছানোর পর ওরা দুই ভাই বাসায় এক রুমে টর্চ জ্বালিয়ে বসে রাত কাটিয়েছে । বাতাসের তীব্রতায় দোতলার জানালা খুলে উড়ে গেছে । দুই ভাই বিভীষিকার মাঝে রাত পার করেছে।

এদিকে আমরা আমার বাবার বাসায়। পর দিন দুপুরে বাসায় গেলাম (ও আর নিজাম রোড)। হালিশহরের আত্মীয় স্বজনরা সব এসে বাসা ভর্তি। আমার ফুফু শ্বাশুড়ী(রিপা ফুফু)ও উনার ছেলেরা,মেরিনা,মিতু,সুরমা সহ অনেকজন। ওখানে পানি আর পানি ।

২৯ শে এপ্রিল ! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।

খাওয়া নেই,খাওয়ার পানি নেই । ঘুমানোর জায়গা নেই । এইভাবে সেদিন পার করে বিকালে গেলাম প্রথমে কুমিরা । মায়ের খোঁজ পাওয়া যায় নাকি কোন। কেউ কি সন্দ্বীপ থেকে আসছে কিনা। কেউ নেই। খাঁ খাঁ করছে চারিদিক।

এরপর সদরঘাট, সেখানেও শুনশান ।এরপর পতেঙ্গা, চারিদিকে ধ্বংসস্তুপ। রাস্তায় পরে আছে লাশ আর গাছ।

তখন চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা আলহাজ্ব মহিউদ্দিন চৌঃ । উনি দ্রুততার সাথে চট্টগ্রামের বিধ্বস্ততা থেকে আবার প্রাণ দেওয়ার জন্য দ্রুত পরিছন্ন করা লাশ দাফন করা,লঙ্গরখানা খুলে অসহায়দের খাবার ব্যবস্থা করা । এয়ারপোর্টের মুখে এসে দেখলাম আড়াআড়ি ভাবে একটা জাহাজ উঠে আছে । রাস্তা ভেঙ্গে দুইভাগ । তখনও সন্দ্বীপের ভয়াবহতা জানিনা । শুধু মায়ের জন্য বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে । এভাবে ৩ দিন সদরঘাট টু কুমিরা করলাম । কুমিরায় গেলে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠত।

২৯ শে এপ্রিল ! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।

প্রকৃতির ধ্বংসলীলা।  নানা,নানীসহ সব আত্মীয় স্বজন সাথে আমার মা সমুদ্রের ঐপাড়ে । কি অবস্থায় আছে কিছু জানিনা।সামীমের সাথে আমরা তিন ভাইবোন কান্না করছি আর কি করব বুঝতে পারছি না।আমাদের অবস্থা দেখে এক লোক বলল একটা চিঠি লিখে দেন পৌঁছাতে পারলে সন্দ্বীপ পাঠাবো । লিখে দিলাম দুই লাইন । এভাবে সদরঘাটেও একজনকে লিখে দিলাম । যদি পৌঁছাতে পারে ।

এভাবে তিনদিন পার হওয়ার পর আবার গেলাম সদরঘাট তখন সন্ধ্যা।ঘাটে কিছু লোকজন জোড় হয়ে আছে।দুই একজনের সাথে কথা হল বলল আজকে একটা জাহাজ আসবে। তীর্থের কাকের মত সবাই অপেক্ষা করছি।

জাহাজ আসল। লোকজনও নামছে জাহাজ থেকে ,অন্ধকার । কোন আলো নেই। এমন সময় দুই একজন লোক একটা ছেলেকে ধরে ধরে আমাদের গাড়ীর দিকে নিয়ে আসছে । খালি গা একটা লুঙ্গী পরা ছেলে। এসে বলল সামীমকে,আমনের গো বাড়ীর মনে হয়। চেনা মানুষ চিনতে পারছি না।আরও কাছে আসল।আমাদের দেখে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে ভাইয়া সব শেষ,সব শেষ। আমরা বললাম তুমি কে? ও কাঁদছে আর বলছে ভাবী আমি আওলাদ ।ও আমার ফুফাতো দেবর । কিন্তু ও এতটাই বিধ্বস্ত যে ওকে চিনতেই পারছি না । গাড়ীতে উঠেই ও বেহুঁশ । ওকে আমরা জিজ্ঞাসা করছি কি হয়েছে । ও কোন কথা বলছে না । তখন যে লোকগুলো ওকে নিয়ে এসেছিল তাদের মধ্য থেকে একজন বলল এম পি সাবের( ওবাইদুল হক) বাড়ীর বহুত মানুষ মারা গেছে । এমন সময় আমার মামা আসল গাড়ীর কাছে । উনার কাছ থেকে জানলাম আমার দাদার বাড়ী,নানার বাড়ীর সবাই ভাল আছেন । আমার মাও ভাল আছেন । আশ্বস্ত হলাম।

এরপর আমরা বাসার দিকে রওনা হলাম আওলাদকে নিয়ে । বাসায় এসে আওলাদকে গাড়ী থেকে নামালাম । আমার ফুফু শ্বাশুডী ছেলেকে দেখে বেহুঁশ হয়ে গেলেন । এভাবে দুই তিন ঘন্টা পার হল ।

আওলাদ কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর জানতে পারলাম বাড়ীর অনেকে মারা গেছে । সবার কান্নাকাটি । ২৯ জন আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন একি বাড়ীতে ।

রাতে যখন পানি আসা শুরু হল সবাই দিশা হারিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিলনা । কাকে নিয়ে কোন দিকে যাবে।মোয়াজ্জেম কাকা (প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক,এ কে একাডেমী।গাছুয়া) বাড়ীতে ছিলেন না । উনি আমার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠিত স্কুল এ কে একাডেমী গাছুয়া সন্দ্বীপের কাজে কুমিল্লা গিয়েছিলেন । উনি থাকলে উনি সবাইকে নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারে যেতেন । কিন্তু উনার না থাকাতে আর যারা ছিলেন উনারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। সন্দ্বীপে আমার শ্বশুরবাড়ী সামনে অনেক দুর খোলা জায়গা এর পর বেড়ীবাঁধ।এত উঁচু হয়ে পানি এসেছে যে প্রথম ধাক্কায় পানি কোন বাঁধাপ্রপ্ত না হয়ে বাড়িতে ঢুকে গেছে । বাড়ীর মানুষ দিশেহারা । পানি দ্রুত গতিতে বাড়ছে । সবাই কি করবে কূলকিনারা পাচ্ছেনা । আমার চাচা শ্বশুর আবু বক্কর কাকার ঘরের উপরের পাঠাতনে বাড়ীর ৮ ঘরের বৌ বাচ্চারা সব উঠে গেছে প্রাণভয়ে ।

অন্ধকার, পানির তীব্রতা, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ভয়ানক । বাড়ীতে মায়ের সাথে দেখা করতে গেছে আমার দুই চাচাতো দেবর । ইউনিভার্সিটি বন্ধ । কিন্তু বেঁচে আসতে পারেনি পারভেজ । মা সহ তিন ভাইবোনের করুণ মৃত্যু । ঘরের পাঠাতনে যারা উঠে ছিল পানির তীব্রতায় পাটাতন ভেঙ্গে পরে পানির নীচে সকলের সলিল সমাধি । মোয়াজ্জেম কাকার আব্বা সহ বাড়ীর আমার চাচী শ্বাশুড়ি ৪ জন,তাদের ছেলে মেয়ে,অতিথি ৩জন,শিশু সহ মোট ২৯ জন এই করুণ মৃত্যু বরণ করেছেন।

কারো লাশ দুইদিন পর কারো লাশ চার/পাঁচ দিন পর খুঁজে পেয়েছে । পুরা বাড়ী মৃত্যপুরী । কেউ কাউকে দেখার নেই। ঘরবাড়িসহ সব নিঃশেষ । চারিদিকে হাহাকার। কি ভয়াবহতা, কি নিষ্ঠুরতা ।

২৯ শে এপ্রিল ! সেই ভয়াল রাতের কিছু কথা।

এভাবেই ১৩টি জেলার ৭৪ উপজেলা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । সন্দ্বীপের মাঝের গ্রাম গুলোতে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি।হারামিয়া,বাউরিয়া,মুছাপুর । হারামিয়া আমার নানা কাজী মোঃ শহিদুল্লাহর (প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, পূর্ব সন্দ্বীপ হাই স্কুল) বাড়ী যেখানে আমার মা ছিলেন । বেশী ক্ষতি হয়েছে গাছুয়া,সন্তোষপুর,কালাপানিয়া,সারিকাইত,আজিমপুর,রহমতপুর সহ কিছু গ্রাম । ৫/৬ দিন পর আমার শ্বশুর কলকাতা থেকে আসলেন । আমার মেঝ ননদের হাজবেন্ড ডাঃ আবদুর রশিদ সহ মেডিকেল টীম ও ত্রান নিয়ে সন্দ্বীপে চলে গেলেন ।

এই মহাপ্রলয় থেকে আজ সবাই আবার ঘুরে দাড়িয়েছে ।  কিন্তু মনের মাঝে রয়ে গেছে সেই মহা প্রলয়ের স্মৃতি । সেই ভয়াল রাতে যারা মৃত্যুবরণ করেছে সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি । আজ ২৯ বছর পর সেই ভয়াল রাতের আমার কিছু স্মৃতি লিখতে ইচ্ছে করল।

আল্লাহর কাছে আকুল প্রার্থনা সেই ভয়াল ২৯ শে এপ্রিলের মত বিভিষীকাময় রাত যাতে আর কখনো না আসে।
একি ভাবে আল্লাহ যেন আমাদের বিশ্ববাসীকে করোনা ভাইরাসের ভয়ানক থাবা থেকে রক্ষা করে আমাদের মাঝে সুন্দর পৃথিবী আবার নতুন করে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের মানবজাতীকে রক্ষা করেন,নিরাপদে রাখেন।
রুমানা নাসরীন।
সহ সভাপতি
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ।
বোর্ড সদস্য,
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।(সি ডি এ)


Skip to toolbar