• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২০ পূর্বাহ্ন

লালমোহন মুজফফর ওয়ার্কশপ- সাজিদ মোহন

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৬০৭ ৪ ৯
আপডেট: শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০
লালমোহন মুজফফর ওয়ার্কশপ
লালমোহন মুজফফর ওয়ার্কশপ

একটি মাত্র সন্তান যাদুমনির। আনন্দ’র বয়স তখন তিরিশ। আমেরিকা যাওয়ার আগে হঠাৎ একদিন বাবাকে চেপে ধরল সে; জীবনের যদি কোন স্বপ্ন থাকে যাদুমনি যেন তাকে বলে। যাদুমনির খুব এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর শখ। তাই কিছুদিন শান্তি নিকেতনে কাটাতে চাইলেন। আর বললেন খুব গোপন একটা স্বপ্নের কথা। গ্রামের দুজন প্রাতঃস্মরনীয় মানুষ লালমোহন সেন আর মুজফফর আহমদ।

ওনাদের নিয়ে বিপ্লবী লালমোহন ও কমরেড নামে আলাদা দুটি বই লিখেছেন যাদুমনি। উৎসর্গ করেছেন নিজের লেখা একটি বই। যদি সম্ভব হয় সন্দ্বীপে ‘লালমোহন মুজফফর ওয়ার্কশপ’ চালু করার খুব ইচ্ছে তার। সংস্থাটি হবে অসাম্প্রদায়িক। প্রশিক্ষক আর প্রশিক্ষার্থী সবাই ব্যস্ত থাকবে, কি করে সুখে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা যায়, কি করে সুন্দর জীবিকা নির্বাহ করা যায়। জীবন ধারনের জন্য যেসব চাহিদা মৌলিক, সে সবই হবে তাদের ধ্যান-ধারনার বিষয়। অলীক ও সাম্প্রদায়িক ব্যাপারগুলো যার যার ব্যক্তিগত। এখানে ভাবনা বিলাস ও রাজনীতি সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। সবাই অসাম্প্রদায়িক সম্ভাষণ রপ্ত করবে; শুভেচ্ছা, কেমন আছেন? বলবে দেখা হলে আর বিদায় নেবার সময় বলবে, শুভেচ্ছা, এখন আসি। ভালো থাকবেন ইত্যাদি। সংস্থার কমনরুমের দেয়ালে লেখা থাকবে সার্বজনীন হিতোপদেশসমূহ; সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই; জগৎ ভ্রমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত; সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে; ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার; সবার আগে খাদ্য।

বছর দুএক পর আমেরিকা থেকে ফিরে ১৯৯৮ এ আকষ্মিক মৃত্যু হল আনন্দর । তারও অনেক পরে ২০০৯ সালে হঠাৎ একদিন ভ্রাতুস্পুত্রী জেসমিনকে যাদুমনি বললেন আনন্দ’র সঙ্গে তার স্বপ্নের ভাগাভাগির কথাটি। জেসমিন জানতে চাইল, ইতোমধ্যে কত টাকা জমেছে।ওয়ার্কশপ করার জন্য তো টাকা দরকার । টাকা? কি করে জমবে? মাসের শুরুতে যাদুমনি পেনশন তোলেন পাঁচ হাজার টাকা। আয় বুঝে ব্যয় করেন। অতঃপর জেসমিনের পরামর্শে পঁচিশ হাজার টাকার এক বছর মেয়াদি ফিক্সড ডিপোজিট করলেন যাদুমনি।

আরো পড়ুনঃ

কিন্তু আনন্দ’র মত আকষ্মিক মৃত্যু হলো জেসমিনেরও। আর তার ঠিক দশ দিন পরেই ২৫ মার্চ ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার ২০১০’ এর সঙ্গে যাদুমনি পেলেন দুই লক্ষ টাকা। ব্যাংকে মোট ফিক্সড ডিপোজিট দাঁড়াল দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। আবার প্রাণ পেল যাদুমনির স্বপ্ন। জেগে উঠলো বুকের ভেতর ছোট্ট ফুলগাছটি। সেই প্রাতঃস্মরনীয় দুজনের একজন লালমোহন সেন।

১৯৩০ সাল। দেশে তখন ইংরেজের রাজত্ব। সংঘাত চলছে দিকে দিকে। দেশের মানুষের সুখী জীবন যাপনের জন্য আগে তাড়াতে হবে বিদেশি শাসককে। কিন্তু কিভাবে? কেউ ভাবছেন, গোপনে গোপনে হাতিয়ার চালানো শিখে লড়াই করে। আর কেউ কেউ ভাবছেন, রাজনৈতিক দল গড়ে দেশের মানুষদের স্বাধীনচেতা করে তবেই বিদেশিদের হটাতে হবে। মাস্টার দা সূর্যসেন চেয়েছিলেন লড়াই করে বিদেশিদের তাড়াতে।

মাস্টারদা’র দলের সবচেয়ে কম বয়সী বিপ্লবী লালমোহন সেন। পরে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকালে নিহত হন তিনি। মুজফফর আহমদের জন্ম ১৯৮৯ সালে একই গ্রাম মুছাপুরে। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সু সাহিত্যিক তিনি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের অগ্রজ অভিভাবক ও বন্ধুপ্রতিম। নজরুল ও মুজফফর দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলেন এবং ১৯২০ সালে উভয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক নবযুগ।

যাদুমনি গ্রামে ফিরলেন। ২৫ নভেম্বর ২০১১ গ্রামের বাড়িতে মুন্সি গোলাম মজিদ পাঠাগারের পাঠযাত্রা শুরু আর পাঠাগার চত্বরে সূচিত হলো লালমোহন মুজফফর ওয়ার্কশপের কর্মযাত্রা। প্রথমত এ উপলক্ষে চারপাশের ৮ টি হাইস্কুলের ১০ম শ্রেণীর ২৫ জন ছাত্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচিত বইপত্রের পাঠচক্র ও তার ভিত্তিতে লিখিত পরীক্ষা। সকল অংশগ্রহণকারীকে প্রশংসাপত্র ছাড়াও ন্যূনতম অর্থানুকূল্য এবং উপহার দেয়া হবে বই।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সন্দ্বীপের ২৮ টি হাইস্কুলের দশম মানের দুজন করে মেধাবী ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাদুমনি শুরু করেন ওয়ার্কশপ; আধুনিক শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ মুন্সী গোলাম মজিদের উপর। ২০১৩ সালের ওয়ার্কশপটি ছিলো কমরেড মুজফফর ও লালমোহন সেনের ওপর। সন্দ্বীপের ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দশম শ্রেণীর দুজন করে ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহন এবং অভিভাবক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ভরিয়ে দিয়েছিলো যাদুমনির প্রাণ।

সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/এসএম 


Skip to toolbar