• বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৮ পূর্বাহ্ন

দশপুরুষের বসতভিটা – সাজিদ মোহন

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৬৩৬ ৪ ৯
আপডেট: সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০
দশপুরুষের বসতভিটা - সাজিদ মোহন
দশপুরুষের বসতভিটা - সাজিদ মোহন

দারা অর্জুন নামের দুই ভাই বহুদিন যাবৎ লাপাত্তা। প্রথমে দারাকে বাঙাল মুলুকের ভুলুয়া (বর্তমানে নোয়াখালী) পরগনায় পাঠানো হয়েছিল খাজনা আদায়ের জন্য।বহূ সংবাদের পরেও সে যখন আসল না, তার তত্ত্বতালাশিতে পাঠানো হলো আরেক ভাই অর্জুনকে। বহূদিন পার হলো। সেও আর ফিরে আসলো না।

বাদশা আলমগীর তখন ভারতবর্ষের অধিপতি। দুই ভাইয়ের অমন উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি বেজায় রাগ হলেন।একদা দিল্লির মসনদে উপবেশনপূর্বক বিমর্ষ বদনে বলে উঠলেন, এখানে এমন কে আছ, যে অবিলম্বে বাঙালমুলুকে যাইয়া ঐ দুই বেইমানকে পাকড়াও করিয়া লইয়া আসিবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন মোগল নৌবহরের কমান্ডার দেলোয়ার খাঁ। সম্পর্কে বাদশার ভাগিনা। বীরের মত গর্জে উঠলো দেলোয়ার। বলল, শাহনেশান মামুজান, আপনার আদেশ পাইলে আজই আমি হুগলি রওয়ানা হইব। হুগলি হইতে নৌযান লইয়া ভুলুয়ায় গিয়া বেইমান দুই ভাইকে কয়েদ করিব।
অনুমতি মিলল। যথাসময়ে দেলোয়ার খাঁ নৌবহর নিয়ে হূগলি থেকে ভুলুয়ায় পৌছুলেন। গোপনে গোপনে দুই ভাই কিন্তু সব খবরই রাখছিলো। সুযোগ বুঝে ভুলুয়া থেকে তারা পালিয়ে গেলো সন্দ্বীপ।দেলোয়ার খাঁও পিছু নিলেন। নৌবহর ভাসালেন সন্দ্বীপের দিকে। দুই ভাই এবার সন্দ্বীপ থেকে পালিয়ে গেলো দূরে কোথাও।
সাগর ঘেরা সন্দ্বীপের বুকে নেমেই মনটা কেমন যেন করে উঠল দেলোয়ার খাঁর।চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। সহজ সরল লোকজন। খুব নিরাপদ এই স্থান জীবন কাটানোর জন্য অতি উত্তম। দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম মেপে ঠিক মাঝখানে তৈরী হল কিল্লাবাড়ি। নৌবহরের প্রবীণ দোভাষী বকশি খাঁ।দেলোয়ার খাঁর সঙ্গে তিনিও চাইলেন, জীবনের শেষ কটা দিন এই দ্বীপেই তার সময় কাটুক। বর্তমান মুছাপুর গ্রামের সর্দারের- গো- পুরান বাড়িতে তৈরী হলো তার বসতভিটা।
একদিন বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে বকশি খাঁ তার নয় দশ বছর বসয়ী পুত্র শমসের খাঁর সঙ্গে বসে আছেন। এমন সময় একজন নিচু জাতের লোক তার সঙ্গে বেয়াদপি করল। রেগে গিয়ে বকশি খাঁ তাকে এক চড় মারলেন। লোকটি নালিশ করতে গেলো দেলোয়ার খাঁর কাছে। দেলোয়ার খাঁর আরেক নাম দিলাল রাজা। তার বিচার ব্যবস্থা ছিলো এমন- যখন কোন স্থানে ঝগড়া বিবাদ হবে, একপক্ষ যদি বলে, আমি নালিশ করতে যাচ্ছি, অন্যপক্ষ সাক্ষিসহ ঐ স্থানে অবস্থান করবে, কোথাও যেতে পারবে না; যতক্ষন না পর্যন্ত পাল্কিতে চেপে দিলাল রাজা সেই স্থানে এসে বিচার করবেন।
আইন অনুযায়ী বকশি খাঁ পুত্রকে নিয়ে বসে রইলেন। একসময় দিলাল রাজার পাল্কি আসলো। রাজার সামনে বকশি খাঁ নিজের কৈফৎ দিলেন। বললেন, এই ছেলে সাক্ষী। শমসের খাঁ বলল, আব্বা হক কথা বলেন। এই বেটা নিচু জাত।বেয়াদপি করেছে। আব্বাজান তাই তাকে মেরেছে। বাচ্চা ছেলের কথা শুনে দিলাল বললেন, তুমিই তো বিচার করে দিয়েছ।আমি আর কি রায় দেবো? তারপর বকশি খাঁকে ডেকে বললেন, তোমার ছাওয়ালকে আমার দরবারে নিয়ে এসো। সবালেগ হলে ওকে আমি সর্দার উজির করবো।
শমসের খাঁ সর্দার উজির হবার পর থেকে গুষ্টির শুরু। শমশের খাঁ তৎপুত্র আজম খাঁ; আজম খাঁ তৎপুত্র পাকখে খাঁ; পাকখে খাঁ তৎপুত্র ফতে খাঁ; ফতে খাঁ তৎপুত্র আলি খাঁ; আলি খাঁ তৎপুত্র তিতাগাজি খাঁ; তিতাগাজি খাঁ তৎপুত্র আজগর খাঁ; আজগর খাঁ তৎপুত্র আবদুল্লা মুন্সী; আবদুল্লা মুন্সী তৎপুত্র গোলাম মজিদ।
গোলাম মজিদ অর্থাৎ যাদুমনির দাদাজি ছিলেন সন্দ্বীপের ইংরেজী পড়ুয়া প্রথম মুসলমান। তার জ্যেষ্ঠপুত্র ইয়াকুব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেট, পরে সন্দ্বীপ দেওয়ানি আদালতে পেশকার নিযুক্ত হন। ইয়াকুব ফুটবল খেলতেন, গান লিখতেন আবার গাইতেনও। ছোটবেলায় তিনি নাকি এক হাতে বাঁশি বাজাতেন, এক পা দিয়ে তবলা ঠুকতেন আর অন্য পা ও কনুই দিয়ে বাজাতেন হারমোনিয়াম।ইয়াকুব পেশকারের দশ সন্তানের মধ্যে যাদুমনি পঞ্চম। জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৬। মায়ের নাম মাহমুদা খানম।
“পরগনার রাজা ছিল দেলোয়ার খাঁন করিলেন তো জোড়া জোড়া লোক অানয়ন তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ছিল বহূ জাতি সন্দ্বীপে করিতে দেন তাদেরে বসতি আনিলেন তো এক ঘর সভ্য মুসলমান সেজারাতে তার নাম দেখি আজম খাঁন আজম খাঁনের পুত্র শমসের খাঁন দশ বছরের ছেলে পাকা বুদ্ধিমান রাজা তারে লালিপালি দিয়ে শিক্ষাদান করিলেন উজির তারে ফার্সিতে কয় সর্দার সেই থেকে সর্দারের গোরের প্রকাশ শমসের আইলো পুনঃ পিতৃগৃহবাস তানপুত্র ফতুআলী তানপুত্র গাজী তানপুত্র সেজারায় আজগর আলী আজগর ছিলেন চাষা খাওনে রাক্ষস পৌনে হাত কই মাছ হতো এক গ্রাস সেড়েক চালের ভাত পেটে দিত গিজী তানপুত্র পিতা মোর আব্দুল্লাহ মুন্সীজি তানপুত্র গোলাম মজিদ তানপুত্র ইয়াকুব পেশকার তানপুত্র বেলাল মোহাম্মদ।”
সন্দ্বীপ জার্নাল/ইএএম/এসএম


Skip to toolbar