• মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:০৫ পূর্বাহ্ন

মাছের জন্য ধান চাষ: সন্দ্বীপের সবুজচরে দিনে কোটি টাকার মাছ বিক্রি

সন্দ্বীপ জার্নাল ডেস্ক: / ৮৯ ৪ ৯
আপডেট: সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

নুরুল আনোয়ার, সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫ | প্রথম আলো অনুসারে পুনর্লিখিত

সন্দ্বীপের সবুজচরে এখন ধানখেত মানেই মাছের ভান্ডার। সাগরে মাছ ধরা সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রতিদিন এই চরের ধানক্ষেত থেকে আহরিত হচ্ছে কোটি টাকার মাছ। কৃষকরা বলছেন—ধান নয়, আসলে মাছের জন্যই তাঁরা এই জমিতে ধান চাষ করেন।


ধানের খেতেই ভাসে সামুদ্রিক মাছ

সবুজ ধানক্ষেতজুড়ে পানি আর সেই পানিতে ভাসছে কোরাল, চিংড়ি ও চিরিং মাছ। খেতের আইলে চাঁই বসিয়ে মাছ ধরছেন চাষিরা। প্রতিদিন ভোর থেকে এই দৃশ্য দেখা যায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সবুজচরে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞায় সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও এই চরের ধানক্ষেত এখন স্থানীয় অর্থনীতির প্রাণ।

চাষিরা জানান, শীতকালে চরটি শুকনো থাকে। চৈত্র মাসের শেষ দিকে জোয়ারের পানিতে জমি প্লাবিত হয়, আর সে সময় পানির সঙ্গে আসে সামুদ্রিক মাছ। এসব মাছ চরে ডিম দেয়, আর জ্যৈষ্ঠ মাসের পর থেকে ডিম ফুটে ছোট মাছ বের হয়। ধানের চারা যখন বেড়ে ওঠে, তখনই মাছও বড় হয়। বর্ষা শেষে শুরু হয় মাছ ধরার মৌসুম, যা চলে টানা কয়েক মাস।


উৎসবমুখর মাছের হাট

বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সকালে দীর্ঘাপাড়ার একতা বাঁধ এলাকায় দেখা যায়, চাষিরা ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ নিয়ে আসছেন হাটে। কোরাল, চিংড়ি, চিরিং, ট্যাংরা, বাটা—বাজারজুড়ে সাজানো নানান সামুদ্রিক মাছ।
ভোর থেকে হাজারো ক্রেতা–বিক্রেতার ভিড়ে মুখর বাজার। স্থানীয় পাইকারদের পাশাপাশি পরিবারিক প্রয়োজনেও অনেকে মাছ কিনতে আসছেন।

চাষি নুর হোসেন বলেন, “সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় এই মাছ আমাদের জন্য নিয়ামত। এতে আমরা যেমন লাভবান হচ্ছি, তেমনি মানুষের চাহিদাও মিটছে।”
অন্য এক চাষি, নিজাম উদ্দিন (৬০), যোগ করেন, “সবুজচর দেশের আমন ধানের অন্যতম ভান্ডার, কিন্তু আমরা ধানের চেয়ে মাছের দিকেই বেশি নজর দিই।”


দিনে আয় প্রায় এক কোটি টাকা

সবুজচর মূলত ‘রাজাশাইল’ ধান উৎপাদনের জন্য পরিচিত। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে তিন হাজার কৃষক যুক্ত আছেন এই চাষে।
ধানক্ষেতের আইলে চাঁই ও স্থানীয় ‘বিন্দি জাল’ পেতে মাছ ধরেন তাঁরা। প্রতিদিন ধরা পড়ছে ২০ থেকে ২৫ টন মাছ—কোরাল, চিংড়ি, চিরিংসহ নানা প্রজাতির।

বিক্রেতারা জানান, চিরিং মাছ প্রতি কেজি ৪০০–৬০০, চিংড়ি ৫০০, আর কোরাল ৬০০–৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ হিসাবে প্রতিদিনের লেনদেন প্রায় এক কোটি টাকার সমান।

স্থানীয় দোকানি জাহেদ বলেন, “হাটে প্রতিদিন এত মাছ বিক্রি হয় যে সঠিক হিসাব কেউ রাখে না। তবে দাম ও পরিমাণ দেখে সহজেই বোঝা যায়—বিক্রি কোটি ছাড়ায়।”

চাষি জামাল উদ্দিন জানান, তিন হেক্টর জমিতে তাঁর আমন চাষে খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। ধান আর খড় বিক্রিতে সেই টাকা উঠে আসে, কিন্তু মাছ বিক্রি করেই বাড়তি কয়েক লাখ টাকা লাভ হয়।


মাছ যায় নোয়াখালী হয়ে ঢাকায়

সবুজচরের মাছ শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন নোয়াখালী হয়ে ঢাকাসহ নানা জায়গায় ট্রলারে করে পাঠানো হয় এসব মাছ।
এক শ্রমিক আলাউদ্দিন বলেন, “শুক্রবার এক ট্রলারে করে ৭০ মণ মাছ নোয়াখালীতে পাঠিয়েছি।”

তবে চাষিরা বলছেন, এলাকায় মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে অনেক সময় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মৎস্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হবে।”
কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেন, “ধান ও মাছ—উভয় দিকেই কৃষকদের আরও লাভবান করতে সমন্বিত সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।”


সবুজচর: ধান আর মাছের অনন্য মেলবন্ধন

সবুজচরের কৃষকরা প্রমাণ করেছেন, এক খেতেই ধান ও মাছের সফল সহাবস্থান সম্ভব।
এই অভিনব চাষপদ্ধতি এখন সন্দ্বীপের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করছে—যেখানে একসময় কেবল ধান ছিল জীবিকার প্রতীক, এখন সেখানে মাছও সমানভাবে ভাগ নিচ্ছে সাফল্যের গল্পে।

দৈনিক প্রথম আলোর মুল প্রতিবেদন:- এখানে


Skip to toolbar